সরকারি কর্মচারীদের বেতন

৫% প্রণোদনায় ব্যয় বছরে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা

অর্থ বিভাগ সূত্র বলছে, ৫ শতাংশ প্রণোদনায় মূল বেতন বাড়বে না। বাড়তি অর্থ থোক হিসেবে পাবেন কর্মচারীরা।

সরকারি কর্মচারীদের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) হয় অর্থবছরের শুরু, অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে। তবে এ বছরের জুলাই মাসে তাঁদের জন্য থাকছে বিশেষ সুখবর। ২০১৫ সালে ঘোষিত বেতনকাঠামো অনুযায়ী প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে যে বেতন বাড়ে, এবার তার সঙ্গে আরও মূল বেতনের ৫ শতাংশ প্রণোদনা যোগ হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, তাদের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী প্রণোদনা দিতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বাড়তি ব্যয় হবে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। উল্লেখ্য, বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮১৮।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত রোববার জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর বক্তব্য দেওয়ার সময় সরকারি কর্মচারীদের জন্য ৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়ার কথা জানান।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর গতকাল সোমবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগে যোগাযোগ করে জানা যায়, তারা এ বিষয়ে প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। এখন একটি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা হবে অর্থমন্ত্রীর কাছে। এরপর তা অনুমোদনের জন্য যাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। জুলাইয়ের প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যেই সব কাজ শেষ হবে। সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার সব কর্মচারীর ক্ষেত্রেই বেতন বৃদ্ধি প্রযোজ্য হবে।

মাত্র তো নির্দেশনা পেলাম। খোঁজখবর নিয়ে এ বিষয়ে পরে কথা বলা যাবে
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল

অর্থ বিভাগ সূত্র বলছে, নিয়মিত যে ৫ শতাংশ মূল বেতন বাড়ে, তার অনুপাতে বাড়িভাড়া ভাতাও বৃদ্ধি পায়। তবে প্রণোদনা বাবদ যে ৫ শতাংশ দেওয়া হবে, তা মূল বেতনে যোগ হবে না। মানে হলো এই অনুপাতে বাড়িভাড়া ভাতা বাড়বে না। শুধু থোক হিসেবে মূল বেতনের ৫ শতাংশ অর্থ পাবেন সরকারি চাকরিজীবীরা।

বিষয়টি নিয়ে জানতে গতকাল প্রথম আলোর পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, প্রণোদনা বাবদ মূল বেতনের ৫ শতাংশের অনুপাতে বাড়িভাড়াও বাড়বে কি না, যা বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে হয়? জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘মাত্র তো নির্দেশনা পেলাম। খোঁজখবর নিয়ে এ বিষয়ে পরে কথা বলা যাবে।’

সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির খবরে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়—এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের এমন কোনো বেতন বাড়ছে না যে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়াটা সংগত হবে।’

মূল্যস্ফীতির চাপে সবাই পিষ্ট। নতুন ঘোষণার ফলে সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটু দম হলো। ইতিবাচকভাবেই দেখছি। কিন্তু বাকি জনগণের জন্য কী হবে? বাজারে তো সবাই যায়।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান

অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রণোদনা এককালীন নয়; বরং প্রতি মাসের বেতনের সঙ্গেই তা পাবেন সরকারি চাকরিজীবীরা। জুলাইয়ের বেতনের সঙ্গেই বাড়তি প্রণোদনা দেওয়ার চেষ্টা থাকবে অর্থ বিভাগের। জুলাইয়ের মধ্যে প্রক্রিয়া শেষ না হলে তা আগস্টে গড়াবে। তবে বাড়তি বেতন কার্যকর হবে জুলাই থেকেই।

সরকারি কর্মচারীদের ১০ থেকে ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হবে, এমন একটা আলোচনা ছিল বাজেট ঘোষণার আগে। তবে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে এ বিষয়ে কিছু উঠে আসেনি। বাজেট উপস্থাপনের আগে গত ১৬ মে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই। তিনি বলেছিলেন, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি করা হবে।

অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি ৫ শতাংশ ও নতুন প্রণোদনা ৫ শতাংশ মিলিয়ে মূল্যস্ফীতি সমন্বয় হয়ে যায়।

বিশেষ প্রণোদনার পরিবর্তে বাস্তবতার আলোকে বেতন বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। সংগঠনটি গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে ২০১৫ সালের বেতনকাঠামো সংশোধনেরও দাবি তুলেছে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির চাপে সবাই পিষ্ট। নতুন ঘোষণার ফলে সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটু দম হলো। ইতিবাচকভাবেই দেখছি। কিন্তু বাকি জনগণের জন্য কী হবে? বাজারে তো সবাই যায়।’

খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পরিবার বা ফ্যামিলি কার্ড ইত্যাদি তো আছে—এ তথ্য তুলে ধরলে সেলিম রায়হান বলেন, ‘তা আছে। কিন্তু সেটা দিয়ে তো আর পাঁচ থেকে সাত দিনের বেশি চলে না। সরকারের উচিত হবে দেশের সব মানুষের জন্য মূল্যস্ফীতি কমানোর ব্যবস্থা করা।’

মূল্যস্ফীতির চাপে পেনশনভোগী ব্যক্তিরা এখন সবচেয়ে কষ্টে আছেন। আমি জানি না, পেনশনভোগী ব্যক্তিদের জন্যও ৫ শতাংশ প্রণোদনা থাকছে কি না।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার

২০১৫ সালের বেতন কমিশনের সুপারিশে বলা ছিল, সরকারি কর্মচারীদের বেতন প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে বাড়বে। অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো বলছে, বর্তমানে প্রতিবছর ৫ শতাংশ বেতন সবার বাড়ে না। কারণ, এ বৃদ্ধি একটা পর্যায়ে গিয়ে থেমে যায়। আবার কারও বাড়ে ৪, কারও সাড়ে ৪ শতাংশ হারে। তাই সে ক্ষেত্রে সবার প্রতিবছর ৫ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা বলা যায় না।

বিদ্যমান বেতনকাঠামো অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতার ২০টি ধাপ (গ্রেড) রয়েছে। সর্বোচ্চ বা প্রথম ধাপের মূল বেতন নির্ধারিত ৭৮ হাজার টাকা। আর ২০তম ধাপের মূল বেতন ৮ হাজার ২৫০ টাকা। বার্ষিক স্বাভাবিক বেতন বৃদ্ধি বাদ দিলে প্রথম ধাপের সরকারি কর্মচারী এবার ৫ শতাংশ প্রণোদনা হিসেবে পাবেন ৩ হাজার ৯০০ টাকা। আর শেষ ধাপের সরকারি কর্মচারী পাবেন ৪১২ টাকা ৫০ পয়সা।

এদিকে বিশেষ প্রণোদনার পরিবর্তে বাস্তবতার আলোকে বেতন বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। সংগঠনটি গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে ২০১৫ সালের বেতনকাঠামো সংশোধনেরও দাবি তুলেছে।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ৭৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে করা হয় ৭৩ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। তবে বাজেট সংক্ষিপ্তসার ২০২৩-২৪ অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮১ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা। বাড়তি প্রণোদনার জন্য অর্থ নেওয়া হবে থোক বরাদ্দ থেকে।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির চাপে পেনশনভোগী ব্যক্তিরা এখন সবচেয়ে কষ্টে আছেন। আমি জানি না, পেনশনভোগী ব্যক্তিদের জন্যও ৫ শতাংশ প্রণোদনা থাকছে কি না।’ তিনি বলেন, ‘সরকারের শীর্ষ পর্যায় বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখবে বলে আশা করি। যদি পেনশনভোগী ব্যক্তিদের এ থেকে বাদ রাখা হয়, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না।’