প্রতিবছর যত মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই দেশে পছন্দমতো কাজ পাচ্ছেন না।
দেশে পছন্দমতো কাজ না পাওয়ায় তরুণ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। তাঁরা কাজের সন্ধানে কিংবা উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৩ সালে কাজের প্রত্যাশায় গড়ে প্রতি ঘণ্টায় দেড় শ বাংলাদেশি দেশ ছাড়ছেন। প্রতিবছর বাংলাদেশিদের জন্য দেশে-বিদেশে যত নতুন কর্মসংস্থান হয়, তার এক-তৃতীয়াংশই হচ্ছে প্রবাসে। স্বল্প শিক্ষিত তরুণদের প্রধান গন্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো।
আবার শোভন কাজ না পেয়ে ও উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় অনেক বাংলাদেশি তরুণ ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হতে চেষ্টা করছেন। তাঁদের কেউ কেউ সফল হন, আবার অনেকে ব্যর্থ হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছেন বা বিভিন্ন দেশের কারাগারে বন্দী জীবন যাপন করছেন। ঝুঁকি নিয়েও এই তরুণ গোষ্ঠী যেন দেশ ছাড়তে মরিয়া।
প্রবাসে জনসংখ্যা বেশি, এমন দেশের তালিকায় বাংলাদেশ এখন ষষ্ঠ। আর প্রবাসী আয় গ্রহণের দিক থেকে অবস্থান সপ্তম। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি কাজ খুঁজে পেয়েছেন কিংবা প্রতিবছর কাজ খুঁজতে যান।
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর শ্রমবাজারে ২০ থেকে ২২ লাখ তরুণ–তরুণী নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন। দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান হয় ১২ থেকে ১৩ লাখের। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয় মজুরিভিত্তিক অনানুষ্ঠানিক খাতে, বাকিরা শোভন চাকরিতে যান। সেই হিসাবে প্রতিবছর তিন লাখের মতো শোভন চাকরি হয়। আর প্রতিবছর ৮ থেকে ৯ লাখ মানুষ প্রবাসে যান। তবে ২০২২ ও ২০২৩ সালে প্রতিবছর ১০ লাখের বেশি নারী-পুরুষ কাজের জন্য প্রবাসে গেছেন।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, চাকরির সিংহভাগই তৈরি হয় বেসরকারি খাতে। কিন্তু শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বড় ধরনের ব্যর্থতা আছে। তাই শিক্ষিত ও অল্প শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে একধরনের হতাশা কাজ করছে। এই হতাশ যুবগোষ্ঠীর অনেকে নিরুপায় হয়ে অসম্ভব কঠিন পথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার চেষ্টা করেন। অনেকে জমিজমা বিক্রি এবং ধারদেনা করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যান, মানবেতর জীবনযাপন করেন। পরিশ্রমের তুলনায় ন্যায্য মজুরি না পাওয়ার অভিযোগও আছে।
দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পেরে বিদেশে কাজের জন্য যাওয়ার প্রবণতা তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেশ বেড়েছে। দুই বছর ধরে প্রতিবছর ১০ লাখের বেশি নারী-পুরুষ বিভিন্ন দেশে গেছেন। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে বিদেশে গেছেন রেকর্ড পরিমাণ—১৩ লাখের বেশি কর্মী। সেই হিসাবে, গত বছর প্রতি ঘণ্টায় গড়ে দেড় শ কর্মী বিদেশে গেছেন। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে বিভিন্ন দেশে যান ১১ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি কর্মী। ২০২৪ সালের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) ৩ লাখ ২২ হাজার ২০৭ জন কাজের জন্য বিদেশে গেছেন।
কোভিডের কারণে বিদেশে কর্মসংস্থান কমে গিয়েছিল। বিএমইটির হিসাবমতে, ২০২০ সালে মাত্র ২ লাখ ১৭ হাজারের মতো কর্মী বিদেশে যান। আর ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ১৭ হাজারের বেশি। কোভিডের আগের বছরে অর্থাৎ ২০১৯ সালে সব মিলিয়ে বিদেশে গেছেন সাত লাখ কর্মী।
বিদেশে প্রতিবছর বিপুল কর্মসংস্থান হলেও অনেকে আবার ফিরেও আসেন। তবে কত প্রবাসী দেশে ফিরে আসেন, এর প্রকৃত হিসাব মেলে না। নিঃস্ব হয়ে; প্রবাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে; পুরোপুরি বাধ্য হয়ে যাঁরা দেশে ফিরে আসেন; শুধু তাঁদের হিসাবই আছে। দেশে ফেরার জন্য বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে তাঁদের একটি আউট পাস (ভ্রমণের বৈধ অনুমতিপত্র) দেওয়া হয়। কেবল এই আউট পাস পাওয়া কর্মীদের হিসাবই পাওয়া যায়।
সরকারের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে এভাবে দেশে ফিরে এসেছেন ৮৬ হাজার ৬২১ জন প্রবাসী। এর মধ্যে পুরুষ ৮৩ হাজার ৭১৯ এবং নারী ২ হাজার ৯০২ জন।
আবার বিদেশে বেশি শ্রমিক গেলেই রেমিট্যান্স বেশি আসবে, তা–ও নয়। গত তিন বছরে সৌদি আরবে প্রায় ১৭ লাখ কর্মী গেছেন। তিন বছর আগে সৌদি আরব থেকে বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ শ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল। কিন্তু এখন বছরে আসে সাড়ে তিন শ কোটি ডলারের মতো। এর মানে, প্রবাসে কর্মী বেশি গেলেও তাঁরা ভালো রোজগার করতে পারছেন না।
মোহাম্মদ রিপনের বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। নিজের গাড়ি চালানোর লাইসেন্স আছে। তিনি বিদেশে যেতে চান। ইতিমধ্যে পাসপোর্টও করে ফেলেছেন। বাড়ির কিছু জমি বিক্রি করে কয়েক মাস আগে একজন দালালের হাতে কিছু টাকা দিয়েছেন। এখন অপেক্ষা করছেন বৈদেশিক চাকরির জন্য।
মোহাম্মদ রিপন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গাড়ি চালাতে জানি। মধ্যপ্রাচ্যে গাড়িচালকদের নাকি অনেক বেতন। তাই পরিবারের সচ্ছলতা আনতে বিদেশ যেতে চাই।’ এখন কী করছেন, এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, আপাতত রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায় একটি ভাড়ার গাড়ি চালান। বেতন ১৫ হাজার টাকা। থাকার ব্যবস্থা করেছে মালিকপক্ষ। এই বেতন দিয়ে বাড়িতে সংসার চলে না।
শোভন কাজ না পেয়ে দেশের শিক্ষিত ও অল্প শিক্ষিত তরুণেরা দেশ ছাড়তে মরিয়া। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে তাঁদের অনেকে ইউরোপে যেতে চান। অনিয়মিত বা অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার যে আটটি রুট চিহ্নিত হয়েছে, তার মধ্যে ভূমধ্যসাগর রুট বেশি ব্যবহৃত হয়। ভূমধ্যসাগর দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে যেতে ইচ্ছুকদের মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকে মারাও গেছেন।
অবৈধভাবে বা অনিয়মিত উপায়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে ফেরত আসতে বাধ্য হয়েছেন, এমন ব্যক্তিদের সহায়তা দেয় ব্র্যাক। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালে মে মাস পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপে পাড়ি দিয়েছেন, এমন বাংলাদেশির সংখ্যা ১ লাখ ৬ হাজার ৫৯৮।
ব্র্যাক সূত্রে জানা গেছে, ওই আট রুটে অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে আটক বা চিহ্নিত বাংলাদেশির সংখ্যা ২০২৩ সালে ছিল ১৫ হাজার ৫০৬, ২০২২ সালে ১৭ হাজার ১০১, ২০২১ সালে ৯ হাজার ২০৮, ২০২০ সালে ৫ হাজার ৪২৬ এবং ২০১৯ সালে ২ হাজার ২৫৪। তবে যাঁরা ইউরোপের কোনো না কোনো দেশে ঢুকতে পেরেছেন, তাঁদের হিসাব জানা যায়নি। তাঁদের বড় অংশই ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, গ্রিসসহ বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন।
জানা গেছে, এভাবে অবৈধভাবে ইউরোপে যেতে আগ্রহী বাংলাদেশি তরুণদের বয়স ৩১ থেকে ৩৫ বছর। তাঁদের ১৫-২০ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। সংখ্যায় ঢাকা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলার তরুণেরাই বেশি। সংশ্লিষ্ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার তালিকায় বাংলাদেশি ছাড়াও আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ যেমন সুদান, আইভরি কোস্ট, মিসর, ইরিত্রিয়ার নাগরিক বেশি।
এ বিষয়ে ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ) শরিফুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমানে দেশে কর্মক্ষম তরুণ জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি। তাহলে তাঁরা কেন বিদেশে চলে যেতে চান, তা নিয়ে গবেষণা করা উচিত। এসব প্রশ্নের উত্তর পেলে সরকারের উদ্যোগ নিতে সুবিধা হবে।’
আবার প্রতিবছর দেশ থেকে অনেক শিক্ষিত তরুণ-তরুণী উচ্চশিক্ষা নিতে বৈধ পথেও ইউরোপ-আমেরিকা যান। ২০২৩ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গেছেন ৫২ হাজার ৭৯৯ জন। তাঁদের বড় অংশ দেশে ফিরে আসবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
একদিকে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি তরুণ যেমন কাজের সন্ধানে বিদেশে যাচ্ছেন, আবার বিদেশিরা এ দেশে কাজের জন্য আসেন। তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীনসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকেরা কাজ করছেন। প্রকৌশলীসহ মধ্যম ও উচ্চপর্যায়ের ব্যবস্থাপনায় তাঁরা কাজ করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে বর্তমানে এক লাখের বেশি বিদেশি কাজ করেন। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) প্রতিবছর ছয়-সাত হাজার বিদেশি নাগরিককে ওয়ার্ক পারমিট (কাজের অনুমতি) দেয়। এসবই সরকারি হিসাব। আরও কয়েক লাখ বিদেশি কর্মী এ দেশে কাজ করেন বলে জানা গেছে। তাঁরা মূলত পর্যটন ভিসা নিয়ে এ দেশে কাজ করতে আসেন বলে অভিযোগ আছে। তাই বাংলাদেশে ঠিক কত বিদেশি কাজ করেন, এর প্রকৃত হিসাব নেই।
গত জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার একটি গবেষণা প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল ৩৪টি দেশের মানুষ নিজেদের অর্থনীতি নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে একটি দেশ বাংলাদেশ। জরিপে অংশ নেওয়া প্রাপ্তবয়স্কদের ৩২ শতাংশ মনে করেন, দেশের অর্থনীতি খারাপ অবস্থায় আছে। বাকিরা ‘ভালো’ মত দিয়েছেন।
তবে কানাডা, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ইতালিসহ উন্নত দেশের প্রাপ্তবয়স্করা নিজেদের অর্থনীতি নিয়ে বেশি নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, পর্যাপ্তসংখ্যক শোভন চাকরি সৃষ্টি হচ্ছে না বলে তরুণেরা হতাশ হয়ে পড়ছেন। নিরুপায় হয়ে তাঁরা বিদেশে যেতে চান। তাই চাহিদা অনুসারে সরকারি-বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে। এ জন্য যুগোপযোগী পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ দরকার। কিন্তু এক দশকে এই চেষ্টা দেখা যায়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে অবকাঠামোর পাশাপাশি নীতি সহায়তার সমন্বয়হীনতা আছে। গ্রাম-শহরনির্বিশেষে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হলে এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। বাজার চাহিদা অনুসারে শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে।