শুরু হয়েছিল গত বছরের শেষ দিক থেকেই, তবে চলতি বছরের প্রথম মাসে যেন বিশ্বের প্রযুক্তি খাতে ছাঁটাইয়ের মচ্ছব শুরু হয়ে গেছে। পৃথিবীজুড়ে প্রযুক্তি খাতে ছাঁটাইয়ের সাম্প্রতিক যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে এ মাসে প্রযুক্তি খাতে দিনে গড়ে তিন হাজার কর্মী ছাঁটাই হয়েছেন। মাইক্রোসফট থেকে শুরু করে গুগল—এমন কোনো কোম্পানি নেই, যারা ছাঁটাই করেনি।
তবে শুধু পশ্চিমা দুনিয়ায় নয়, ইকোনমিক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে যে ছাঁটাই চলেছে ভারতেও—তথ্যপ্রযুক্তি জগতে যেটি শীর্ষস্থানীয় দেশ। ছাঁটাইয়ের কারণ হিসেবে বিশ্লেষকেরা দুটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত, করোনাভাইরাস মহামারির লকডাউনের সময় বাড়তি চাহিদা মেটাতে বিপুল কর্মী নিয়োগ দেওয়া। দ্বিতীয়ত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ।
এমন এক সময়ে এই ছাঁটাই চলছে, যখন বিশ্বের প্রায় সব অর্থনীতিবিদ ও বৈশ্বিক সংস্থাগুলো ক্রমেই বলে যাচ্ছে, এ বছর মন্দা হবে বা তা না হলেও প্রবৃদ্ধির গতি অনেকটাই কমে যাবে। ছাঁটাইয়ের প্রক্রিয়ায় চলতি মাসে এ পর্যন্ত ৬৫ হাজার কর্মীর চাকরি গেছে আর এর আগের বছরে অর্থাৎ ২০২২ সালে চাকরি গেছে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৩৬ কর্মীর। ছাঁটাইয়ের প্রক্রিয়া অনুসরণকারী কোম্পানি লেঅফস ডট এফওয়াইআইর সূত্রে এ তথ্য দিয়েছে ইকোনমিক টাইমস।
এদিকে বৈশ্বিক এ প্রবণতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভারতের স্থানীয় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোতেও ছাঁটাই চলছে। দেশটির স্থানীয় সামাজিক মাধ্যম শেয়ারচ্যাট ২০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করেছে মূলত বাজারের অনিশ্চয়তার কারণে।
ভারতের মহিরুহ তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি উইপ্রো ৪০০ নতুন কর্মীকে খারাপ পারফরম্যান্সের অভিযোগে ছাঁটাই করেছে। এ ছাড়া খাদ্য সরবরাহকারী কোম্পানি সুইগি ৩৮০ কর্মী ছাঁটাইয়ের কথা স্বীকার করেছে।
আরেক খাদ্য সরবরাহকারী সোফোসও বিশ্বজুড়ে ৪৫০ কর্মী ছাঁটাই করেছে।
সব কোম্পানিই ছাঁটাইয়ের পেছনে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা বলেছে। সবাই টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে ব্যয় সাশ্রয়ের নীতি গ্রহণ করেছে।
মহামারির সময় বিশ্বের বিপুলসংখ্যক মানুষ ঘরে থেকে কাজ করেছেন। এতে তখন প্রযুক্তির চাহিদা বেড়ে যায়। অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে বিপুল কর্মী নিয়োগ দিয়েছে বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানি। কিন্তু এখন চাহিদা কমে যাওয়ায় কর্মীদের বিদায় করা হচ্ছে।
গত কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো বিপুল কর্মী ছাঁটাই করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য বিশ্লেষণকারী কোম্পানি ক্রাঞ্চবেসের তথ্যানুসারে, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ৮৮ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে। শুধু প্রযুক্তি কোম্পানি নয়, বেসরকারি খাতের বড় বড় ব্যাংকও কর্মীদের দরজা দেখিয়ে দিচ্ছে।
ওয়েলস ফারগো বন্ধকি ঋণ বিভাগের কয়েক শ কর্মী ছাঁটাই করেছে। নভেম্বরে বার্কলে প্রায় ২০০ কর্মী ছাঁটাই করেছে। কর্মী ছাঁটাই করেছে ওয়াল স্ট্রিটের মহিরুহ হিসেবে পরিচিত গোল্ডম্যান স্যাকস ও সিটি গ্রুপ। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের তথ্যানুসারে, প্রধান কার্যালয়ের কয়েক শ কর্মী ছাঁটাই করেছে পেপসিকো।
বিষয়টি হচ্ছে, বিশ্বের প্রযুক্তি খাত বিশ্বায়িত ইকোসিস্টেম হিসেবে গড়ে উঠেছে। ফলে এ জায়গায় চাহিদা কমলে তার প্রভাব অন্য জায়গায়ও পড়ে। ভারতে এখন তা-ই হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এই মুহূর্তে বিপুল ছাঁটাইয়ের আরেকটি বড় কারণ হিসেবে বিশ্লেষকেরা চিহ্নিত করছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’কে (এআই)। এআই খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ক্রমেই বাড়াচ্ছে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো। এতেই তৈরি হয়েছে অর্থের সংকট।
দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, প্রযুক্তির যা গতি-প্রকৃতি, তাতে এই মুহূর্তে এআই খাতে কেউই বিনিয়োগ কমানোর ঝুঁকি নিতে চাইছে না। কিন্তু এখনই তা থেকে আয় বৃদ্ধির নতুন পথ বেরোচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে কর্মী ছাঁটাই এবং তা করেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে তারা।
এদিকে সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে। ২০২২ সালের অক্টোবরে দেখা যায়, গত বছরের তুলনায় গুগলের মুনাফা কমেছে ২৭ শতাংশ, আর্থিক হিসাবে যা ১ হাজার ৩৪০ কোটি ডলার। এসব কারণে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটছে।
বহুজাতিক মানবসম্পদ কোম্পানিগুলোর দাবি, ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি ছাঁটাই হয়েছে প্রযুক্তি খাতে। কেবল প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন এমন ৯৭ হাজার ১৭১ জন গত বছর চাকরি হারিয়েছেন, যা গত বছরের তুলনায় ৬৪৯ শতাংশ বেশি বলে জানিয়েছে ব্লুমবার্গ।