বিশ্ব অর্থনীতি

সাধারণ একটি ব্যাংক নোট বিশ্বে যেভাবে আধিপত্য বিস্তার করল

ব্যাংক নোট হিসেবে প্রথম ডলার ছাপা হয়েছিল ১৯১৪ সালে। এর এক বছর আগে হয় ফেডারেল রিজার্ভ আইন, যার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক। সেই হিসাবে ডলারের বয়স ১০৮ বছরের কাছাকাছি।

ডলার
ছবি: সংগৃহীত

ইংরেজ কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার উইলিয়াম সমারসেট মমের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘অর্থ হচ্ছে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, এটি ছাড়া আপনি বাকি পাঁচ ইন্দ্রিয়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবেন না।’ বিশ্বব্যাপী এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের নাম হলো ডলার। এ লেখায় আজ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টির ঠিকুজি-কোষ্ঠী নির্ণয় করব।

প্রতিটি দেশের নিজস্ব মুদ্রা রয়েছে। আমাদের যেমন টাকা, যুক্তরাষ্ট্রের তেমনি ডলার। কিন্তু টাকা দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয় না, এর জন্য প্রয়োজন ডলারের। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ ডলারে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করে। অর্থাৎ, কোনো পণ্য আমদানি করলে তার বিল মেটায় ডলারে, আবার কোনো পণ্য রপ্তানি করলে তার জন্য অর্থ পায় ডলারে। বিশ্বজুড়ে ডলারকে তাই বলা হয় ‘রিজার্ভ মুদ্রা’। বিশ্বে যত লেনদেন হয়, তার ৮৫ ভাগ হয়ে থাকে ডলারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুসারে, বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর রিজার্ভের প্রায় ৬২ শতাংশই মজুত আছে ডলারে। বাকি অংশের মধ্যে ২০ শতাংশ আছে ইউরোতে। জাপানের ইয়েন ও ব্রিটিশ পাউন্ডে সংরক্ষিত আছে প্রায় ৫ শতাংশ করে রিজার্ভ।

ডলারের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে একটা উদাহরণ প্রায়ই দেওয়া হয়। তা হলো, সমুদ্রে কোনো জলদস্যু গোষ্ঠী যদি কাউকে অপহরণ করে, তাহলে মুক্তিপণ দাবি করে ডলারে, অন্য কোনো মুদ্রায় নয়। আবার ডলারের মূল্য বাড়া-কমার সঙ্গে ঢাকার রাস্তায় একটি পাউরুটির দামও ওঠানামা করে। ডলারের এতই গুরুত্ব। এ মাসের শুরুর দিকে ঢাকার খোলাবাজারে প্রতি ডলার বিক্রি হয় ১২০ টাকায়। পাকিস্তানে একটি ডলার কিনতে লাগছে ২০০ রুপি আর ভারতে ৮০ রুপি।

একটু ইতিহাস

ডলার কীভাবে বিশ্বব্যাপী রিজার্ভ মুদ্রা হলো! সাধারণ একটি ব্যাংক নোট কীভাবে বিশ্বব্যাপী এতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠল এবং প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছে, আর তা কি চলতেই থাকবে? আমেরিকান ডলারের বিপরীতে চীনের মুদ্রা ইউয়ান কিংবা রাশিয়ার মুদ্রা রুবল কি বিকল্প হতে পারবে? কয়েক দশক ধরে চলা এই প্রশ্ন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর যেন জোরালো হয়ে উঠেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কাগুজে মুদ্রা বাজারে আসে সে দেশের স্বাধীনতার আগে, ১৬৯০ সালে। তখন মূলত সেনাবাহিনীর ব্যয় মেটানোর জন্য ওই মুদ্রা ব্যবহৃত হতো। স্বাধীনতার ৯ বছর পর ১৭৭৬ সালে প্রথম গ্রহণ করা হয় ডলার চিহ্ন ($)।

ব্যাংক নোট হিসেবে প্রথম ডলার ছাপা হয়েছিল ১৯১৪ সালে। এর এক বছর আগে হয় ফেডারেল রিজার্ভ আইন, যার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক। সেই হিসাবে ডলারের বয়স ১০৮ বছরের কাছাকাছি।

যতই অশুভ মনে করা হোক, ডলারে রয়েছে ‘১৩’ সংখ্যার ছড়াছড়ি। যার পিরামিড ‘১৩’ ধাপের, ইগলের নখরের সংখ্যা ‘১৩’, গ্রেট সিলের ‘১৩’টি রেখা ও ‘১৩’টি নক্ষত্র। ডলার তৈরিতে ব্যবহৃত হয় তুলা আর লিলেন। কাগজের কোনো কিছু এতে নেই। ডলারে লেখা আছে একটি নীতিবাক্য—ইন গড উই ট্রাস্ট, যা ১৯৬৩ সালে সংযোজিত হয়।

ডলারের আগে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য ছিল ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ডের। ১৯২০ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছে এই মুদ্রা। মূলত ডলার আসার আগে ৫০০ বছর ধরে যেসব মুদ্রা রাজত্ব করেছে, তার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস ও স্পেনের মুদ্রা। বিশ্বের নানা প্রান্তে এসব দেশের কলোনি থাকায় তাদের মুদ্রাও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৮) যুক্তরাষ্ট্র যোগ দেয় আড়াই বছর পরে। সেই অর্থে যুদ্ধের আঁচড় দেশটির গায়ে লাগেনি। উপরন্তু, যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদেশগুলোর কাছে প্রচুর অস্ত্র ও সরঞ্জাম বিক্রি করে। বিক্রীত রসদের মূল্য গ্রহণ করে সোনা দিয়ে। এভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসতে আসতে বিশ্বের মোট মজুত সোনার একটি বড় অংশই যুক্তরাষ্ট্রের কোষাগারে জমা হয়। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র শেষ মুহূর্তে যোগ দেয়। ওই সময়ও মিত্রদের কাছে প্রচুর সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে নিজেদের কোষাগারে বিপুল স্বর্ণমুদ্রার মজুত ঘটায় যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপ তখন বিধ্বস্ত। মানুষের হাতে কাজ নেই।

ডলার যেভাবে রিজার্ভ মুদ্রা

এ অবস্থায় ১৯৪৪ সালে ৪৪টি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ব্রেটন উডস শহরে আলোচনায় মিলিত হয়। সে সময় একটা চুক্তি করে তারা। সিদ্ধান্ত হয়, এসব দেশের মুদ্রার বিনিময়মূল্য নির্ধারিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের ওপর ভিত্তি করে। আর ডলারের মূল্য নির্ধারিত হয় তখন সোনার ওপর ভিত্তি করে। ১৯৪৭ সালে বিশ্বের মোট মজুত করা সোনার ৭০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের হস্তগত ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বিপুল সোনা মজুত এবং ডলারের মূল্য স্থিতিশীল থাকায় সেসব দেশ তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভ কারেন্সি (মুদ্রা) হিসেবে ডলার সংরক্ষণে একমত হয়। মূলত ডলারের আধিপত্য সেই থেকে শুরু।

প্রসঙ্গত, ব্রেটন উডস চুক্তির মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক। ঐতিহ্যগতভাবে আইএমএফের প্রধান নির্বাচিত হন ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে আর বিশ্বব্যাংকের প্রধান নির্বাচিত হন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো এবং জাপানের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। তারা ডলার দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সোনা কিনতে থাকে। কমতে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের সোনার মজুত। এর ওপর আবার ভিয়েতনাম যুদ্ধে ব্যয় মেটানোর চাপে ওয়াশিংটন বিপুল পরিমাণ কাগুজে মুদ্রা ছাপাতে শুরু করে। কঠিন হয়ে পড়ে ডলারের সঙ্গে সোনার সংযোগ বজায় রাখা।

এভাবে আসে ১৯৭১ সাল। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ঘোষণা করেন, সোনার ওপর ভিত্তি করে ডলারের মূল্য আর নির্ধারিত হবে না, যা ‘নিক্সন শক’ নামে পরিচিত। এর মধ্য দিয়ে ডলার হয়ে পড়ে ‘ফিয়াট মানি’। তারপরও ডলারের গুরুত্ব কমল না। বিশ্বজুড়ে এর কর্তৃত্ব ধরে রাখতে ১৯৭৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যে তীব্র উত্তেজনার মধ্যে সৌদি আরবের সঙ্গে এক ঐতিহাসিক চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র। এতে বলা হয়, সৌদি আরব থেকে বিশ্বের যেসব দেশ জ্বালানি তেল আমদানি করবে, তাদের মূল্য পরিশোধ করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারে। বিনিময়ে সৌদি আরবকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে যুক্তরাষ্ট্র। এর দুই বছর পর ১৯৭৫ সালে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেক সৌদি আরবের মতোই সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থাৎ তেল বিক্রির সব অর্থ পরিশোধ করতে হবে শুধু ডলারে। এভাবে দিনে দিনে বিশ্বব্যাপী ডলারের আধিপত্য বাড়তে থাকে।

অন্য মুদ্রার সম্ভাবনা কতটা

এক দশকের বেশি সময় ধরে বিশ্বের অনেক দেশ ডলার ছাড়া অন্য মুদ্রায় পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করা যায় কি না, সেই চেষ্টা করছে। সম্প্রতি রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পর রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের আধিপত্য নিয়ে নতুন করে কথা হচ্ছে। সম্প্রতি রাশিয়া, চীন ও ব্রিকস দেশগুলো একটি অভিন্ন রিজার্ভ মুদ্রা চালুর ব্যাপারে সম্মত হয়েছে, যা ডলারের আধিপত্যকে কিছুটা হলেও খর্ব করতে পারে বলে অর্থনীতিবিদেরা আশঙ্কা করছেন।

রাশিয়া ইউরোপের দেশগুলোকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, রুবলে মূল্য পরিশোধ না করলে তারা গ্যাস ও তেল রপ্তানি করবে না। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার ফলে ক্রেমলিন তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অর্ধেক ব্যবহার করতে পারছে না। কারণ, এই রিজার্ভ রাখা হয়েছিল ডলার ও ইউরোয়। আগস্টের শুরুতে রাশিয়ার রিজার্ভ ছিল ৫৭৫ বিলিয়ন ডলার। ইতিমধ্যে রাশিয়া কিছু ‘শাস্তিমূলক’ ব্যবস্থাও নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের হুমকিকে পাত্তা না দিয়ে কোনো কোনো দেশ রুশ শর্ত মেনেই তেল-গ্যাস আমদানি শুরু করে দিয়েছে। অতি সম্প্রতি ভারতের এক সিমেন্ট কোম্পানি রাশিয়া থেকে কয়লা আমদানি করেছে চীনের ইউয়ানের বিনিময়ে।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, তারপরও ডলারকে কাবু করা সহজ হবে না। যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের সুদের হার বাড়িয়ে দেয়, তাহলে পুরো বিশ্বই বড়সড় ধাক্কা খাবে। ডলারনির্ভর বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক সারা বিশ্বের অর্থনীতির ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারে।

তা ছাড়া ডলারের আরেকটি শক্তিশালী দিক হলো, এর মূল্য নির্ধারিত হয় বাজারের গতিপ্রকৃতির ওপর। এখানে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ থাকে না বললেই চলে। ইউরোপীয় দেশগুলোর অভিন্ন মুদ্রা ইউরোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু রুবল বা ইউয়ানে সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে।

বিগত শতকের সত্তরের দশকে ‘ফিয়াট মানি’ ঘোষিত হওয়ার পর ডলারের মৃত্যু ঘটবে এমন আশঙ্কা করা হয়েছিল। এরপরের দুই দশকে আলোচনা ছিল ডলারের কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেবে জাপানের ইয়েন। শূন্য দশকে এসে শোনা গেল ইউরোর নাম। এখন চীনের ইউয়ানের কথা বলা হচ্ছে। এত কিছুর পরও ডলারের রাজত্ব কমেনি এতটুকু। সম্প্রতি রাশিয়া অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় ডলার ও ইউরোর জয়জয়কার ধ্বনিত হচ্ছে। উইলিয়াম সমারসেট মমের সেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টি তাই নিঃসন্দেহে ডলারই।