আইনে আলাদা জিআই ইউনিট প্রতিষ্ঠার কথা বলা আছে। কিন্তু ১১ বছরেও তা হয়নি। ফলে দক্ষ জনবলও তৈরি হয়নি।
দুটি আইনে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি প্রদান ও নিবন্ধনের জন্য পৃথক একটি ইউনিট প্রতিষ্ঠার কথা বলা থাকলেও তা এখনো হয়নি। দায়িত্বটি দেওয়া হয়েছিল শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরকে (ডিপিডিটিকে)। কিন্তু বছরের পর বছর পার হলেও সংস্থাটি সে কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রসিদ্ধ পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতি দিতে ২০১৩ সালে পাস হওয়া ‘ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন’ এবং ২০২৩ সালের ‘বাংলাদেশ শিল্প-নকশা আইন’-এ পৃথক জিআই ইউনিট করার কথা বলা হয়েছে।
জানা গেছে, আলাদা ইউনিট না থাকায় স্থায়ী জনবল নিয়োগ দেওয়া যায়নি। ফলে দক্ষ জনবলও তৈরি হয়নি। ডিপিডিটির কর্মকর্তাই অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে জিআই স্বীকৃতি নিয়ে কাজ করছেন। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটির জিআই-সংক্রান্ত কাজ অনেকটা ধীরগতিতে চলছে এবং নথিপত্র সংরক্ষণ নিয়েও প্রায়ই জটিলতা তৈরি হয় বলে অভিযোগ আছে।
জিআই পণ্যের সুরক্ষা দিতে না পারলে অন্যরা এগুলোর মেধাস্বত্ব নিয়ে নেবে। তখন জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পেশা এবং বাজারও হারাব আমরা।ফাহমিদা খাতুন, নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি
ডিপিডিটির পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) আলেয়া খাতুন প্রথম আলোকে জানান, ‘জনবলের অভাবে পৃথক জিআই ইউনিট গঠনে দেরি হচ্ছে। বর্তমানে পৃথক একটি ইউনিট করার কাজ চলছে। আশা করছি, দ্রুততম সময়ে সেখানে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হবে।’
সম্প্রতি ভারতে টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর বাংলাদেশে নানা মহলে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। এরপর ঊর্ধ্বতন মহলের নির্দেশে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো নড়েচড়ে বসে। ৬ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল শাড়ির জিআইয়ের জন্য আবেদন করে জেলা প্রশাসন। সেদিনই আবেদনটি অনুমোদন করা হয়।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে জিআই স্বীকৃতি খুব তাৎপর্যপূর্ণ। তবে বাংলাদেশ বিভিন্ন পণ্যের জিআই স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। প্রতিবেশী ভারত ১৯৯৯ সালে জিআই আইন তৈরি করে। ২০০৪ সালের এপ্রিলে দেশটি দার্জিলিং চা-কে প্রথম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দেয়। ভারতে এখন পর্যন্ত ৫৪৭টি পণ্য জিআই সনদ পেয়েছে। এই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ২৭টি পণ্য রয়েছে। এসব পণ্যের মধ্যে আছে নকশিকাঁথা, টাঙ্গাইল শাড়ি, সুন্দরবনের মধুর মতো পণ্যও।
অন্যদিকে ২০১৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে জামদানি শাড়ি স্বীকৃতি পায়। এরপর ডিপিডিটি ইলিশ, রংপুরের শতরঞ্জি, রাজশাহী সিল্ক, ঢাকাই মসলিন, বগুড়ার দই, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, কুমিল্লার রসমালাই, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরশাপাতি আম, বিজয়পুরের সাদা মাটি, দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল, বাংলাদেশ কালিজিরা, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম, বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি, বাংলাদেশের শীতলপাটি, শেরপুরের তুলসীমালা ধান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম, বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর চমচম, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা এসব পণ্যকে জিআই সনদ দেয়।
সম্প্রতি টাঙ্গাইল শাড়ি, নরসিংদীর অমৃত সাগর কলা, গোপালগঞ্জের রসগোল্লা, রংপুরের হাঁড়িভাঙা আম, মৌলভীবাজারের আগর, মৌলভীবাজারের আগর–আতর, মুক্তগাছার মণ্ডা, যশোরের খেজুরের গুড়, রাজশাহীর মিষ্টি পান ও জামালপুরের নকশিকাঁথাকে দেশের জিআই পণ্য হিসেবে অনুমোদন করে ডিপিডিটি। এ নিয়ে বাংলাদেশের অনুমোদিত জিআই পণ্যের সংখ্যা দাঁড়াল ৩১।
ডিপিডিটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৩ সালের জিআই আইনের পাশাপাশি ২০২৩ সালে পাস হওয়া বাংলাদেশ শিল্প-নকশা আইনে আলাদা জিআই ইউনিট করার কথা বলা হয়েছে। তবু ডিপিডিটিতে এখনো পৃথক জিআই ইউনিট তৈরি হয়নি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘জিআই পণ্যের সুরক্ষা দিতে না পারলে অন্যরা এগুলোর মেধাস্বত্ব নিয়ে নেবে। তখন জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পেশা এবং বাজারও হারাব আমরা। জিআই স্বীকৃতি প্রদান ও এ বিষয়ে প্রচার চালানো একটি ধারাবাহিক কাজ। এ জন্য আলাদা জিআই ইউনিট গঠন ও দক্ষ জনসম্পদ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।’
ডিপিডিটির পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) আলেয়া খাতুন জানান, করোনাসহ বিভিন্ন কারণে জনবলকাঠামোর খসড়া তৈরিতে বিলম্ব হয়েছে। খসড়াটি চূড়ান্ত করে সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো থেকে অনুমোদন পেলে দ্রুত পৃথক জিআই ইউনিট স্থাপনের কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে।