বাজেটে অর্থের জোগান দিতে করবহির্ভূত রাজস্ব (এনটিআর) আদায় বৃদ্ধির বিষয়ে মনোযোগী হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। পাশাপাশি ‘নন-এনবিআর কর–রাজস্ব’ হিসেবে পরিচিত এনবিআর–বহির্ভূত কর–রাজস্ব আদায়ও এ সরকার বাড়াতে চায়।
এমন সিদ্ধান্তের অর্থ হচ্ছে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর ও সংস্থা ফি বা মাশুলের বিনিময়ে মানুষকে যেসব সেবা দেয়, সেগুলো থেকে আয় বাড়বে। সরকারি ভাষায় বিষয়টি এভাবে বলা হয়েছে, ‘সেবার মাশুল তিন বছর পরপর অথবা প্রয়োজনের নিরিখে যথাসময়ে হালনাগাদ হবে।’ তবে সেগুলো করা হবে সেবা দেওয়ার খরচ, জীবনযাত্রার মান, মূল্যস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় বিবেচনায় রেখে।
এনটিআর ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড–বহির্ভূত (নন-এনবিআর) কর–রাজস্ব সংগ্রহ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কথা বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ গত রোববার একটি নতুন নির্দেশিকা জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, এনটিআর ও নন-এনবিআর রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা আছে। এ দুটি উৎস থেকে আদায় বৃদ্ধির জন্য একটি সময়োপযোগী নির্দেশিকা প্রণয়নের দরকার ছিল, সেটাই এখন করা হলো।
এ নিয়ে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, দেশে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির অনেক সুযোগ রয়েছে। আপাতত এনটিআর ও নন-এনবিআর কর-রাজস্ব বৃদ্ধির নির্দেশিকা জারি করেছে অর্থ বিভাগ। এনবিআর–নিয়ন্ত্রিত কর–রাজস্ব বৃদ্ধির কাজও চলছে।
নির্দেশিকায় বলা হয়, এনটিআর ও নন-এনবিআর কর–রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, যৌক্তিক মাশুল ও কর আরোপ, সঠিক খাত চিহ্নিতকরণ, সরকারের প্রাপ্য সুদ ও লভ্যাংশ নিয়মিতভাবে আদায় এবং সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন, সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে নির্দেশিকাটি প্রণয়ন করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো এখন থেকে যে যার জায়গা থেকে এনটিআর ও নন–এনবিআর কর–রাজস্বের আওতা সম্প্রসারণের জন্য নতুন নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। এনটিআর ও নন–এনবিআর কর–রাজস্ব আদায়ের দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রয়োজনে প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে।
নির্দেশিকা অনুযায়ী, আদায় করা রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় চালান বা এ-চালান ব্যবহার করতে হবে। রাজস্ব জমা দেওয়ার তথ্য এবং টাকার পরিমাণ, খাত, চালান নম্বর ইত্যাদি নির্দিষ্ট রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করে রাখতে হবে। মাশুল, টোল, ইজারা, ভাড়া ইত্যাদি যেদিন আদায় করা হবে, সেদিনই জমা দিতে হবে। তবে অফিস সময়ের পরে বা সরকারি ছুটির দিনে আদায় হলে তা পরের কর্মদিবসে সরকারি কোষাগারে জমা করতে হবে।
দেশে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির অনেক সুযোগ রয়েছে। আপাতত এনটিআর ও নন-এনবিআর কর-রাজস্ব বৃদ্ধির নির্দেশিকা জারি করেছে অর্থ বিভাগ। এনবিআর নিয়ন্ত্রিত কর-রাজস্ব বৃদ্ধির কাজও চলছে।সালেহউদ্দিন আহমেদ, অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা
ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে এনটিআর ও নন–এনবিআর কর–রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে অর্থ বিভাগে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। মন্ত্রণালয় বা বিভাগগুলোকে সেবার মূল্য বা মাশুল নির্ধারণ, পুনর্নির্ধারণ অথবা অপরিবর্তিত রাখার যৌক্তিকতা নিরূপণ করে একটি বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদন প্রতিবছর অক্টোবর মাসে অর্থ বিভাগে পাঠাতে হবে।
নির্দেশিকায় অর্থ বিভাগের করণীয় সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ বিভাগ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ত্রৈমাসিক পর্যালোচনা সভা করবে এবং মাশুল নির্ধারণ, পুনর্নির্ধারণ বা আরোপের বিষয়ে মতামত দেবে। অর্থ বিভাগ এনটিআর ও নন–এনবিআর রাজস্ব নীতি প্রণয়নের ব্যবস্থাও গ্রহণ করবে। বিভাগটি সব ধরনের সরকারি সেবার একটি তথ্যভান্ডারও (ডেটাবেজ) তৈরি করবে।
নির্দেশিকা বলা হয়, টাকা জমা দিতে ব্যর্থ হলে এবং নির্দেশিকার কোনো শর্ত পালন না করলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কী ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে—এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থ বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের আইনকানুনের অভাব নেই।
দেশের চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এতে অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এই বাজেটে ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকার অনুদানসহ মোট রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে নন-এনবিআর কর ১৫ হাজার কোটি এবং এনটিআর ৪৬ হাজার কোটি। অর্থাৎ অর্থ বিভাগের চাওয়া হলো ৬১ হাজার কোটি টাকা বা পারলে আরও বেশি আদায় করা।
এনটিআর ও নন-এনবিআর কর কোনগুলো
এনটিআর খাতের মধ্যে রয়েছে লভ্যাংশ ও মুনাফা, সুদ, প্রশাসনিক মাশুল, জরিমানা, ভাড়া ও ইজারা, টোল, অবাণিজ্যিক বিক্রি, সেবা প্রাপ্তি, মূলধন রাজস্ব ও কর ছাড়া অন্যান্য রাজস্ব। নন-এনবিআর কর–রাজস্ব হলো মাদক শুল্ক, যানবাহন কর, ভূমি রাজস্ব, নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প বিক্রি ও সারচার্জ।
চলতি অর্থবছরে স্ট্যাম্প বিক্রি থেকে ১০ হাজার কোটি, লভ্যাংশ ও মুনাফা থেকে ৭ হাজার ৬৭৬ কোটি, সুদ বাবদ ৬ হাজার ১১৪ কোটি, টোল হিসেবে ১ হাজার ৯১৫ কোটি ও ভূমি রাজস্ব বাবদ ২ হাজার ২৫০ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে এনটিআর ও নন-এনবিআর কর হালনাগাদ হতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, ব্যবসা সহজীকরণ যেন বাধাগ্রস্ত না হয়। পুরো প্রক্রিয়ায় উৎকর্ষ আনতে ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, কর-জিডিপির হারে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে। এ ক্ষেত্রে উন্নতি করতে হলে এনবিআর নিয়ন্ত্রিত আয়কর, ভ্যাট ইত্যাদি আদায়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার।