অর্থ মন্ত্রণালয়
অর্থ মন্ত্রণালয়

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ নিয়ে কি নতুন কোনো সিদ্ধান্ত আসছে

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কি শেষ পর্যন্ত বিলুপ্তই হতে চলেছে—আর্থিক খাতে এমন প্রশ্ন এখন ঘুরেফিরেই আসছে। বিভাগটির শেষ সচিব ছিলেন মো. আবদুর রহমান খান, যিনি বর্তমানে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান। এর পর থেকে এ বিভাগে কোনো সচিব নেই।

আবদুর রহমান খান আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ছিলেন তিন মাস (১৯ মে থেকে ১৯ আগস্ট)। তিনি এ বিভাগের নিয়মিত সচিব ছিলেন গত ১৪ আগস্ট পর্যন্ত। গত ১৬ মে আগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) গেলে ওই দিনই আবদুর রহমান খানকে বিভাগটির সচিব পদে নিয়োগ দেওয়ার প্রজ্ঞাপন জারি হয়। প্রজ্ঞাপনে কার্যকরের দিন ছিল ১৯ মে এবং ওই দিনই তিনি বিভাগটিতে যোগ দেন।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ১০ দিনের মাথায় আবদুর রহমান খানকে এনবিআরের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ১৫ আগস্ট ভিন্ন এক প্রজ্ঞাপনে তাঁকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব হিসেবেও অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয় সরকার। পাঁচ দিনের মাথায় গত ২০ আগস্ট অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মফিদুর রহমানকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরদিন ২১ আগস্ট এ প্রজ্ঞাপনও বাতিল করা হয়। ওই দিন নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে এ বিভাগের সচিবের দায়িত্ব পালন করার সুযোগ দেওয়া হয় বিভাগটিরই অতিরিক্ত সচিব অমল কৃষ্ণ মণ্ডলকে। সেই থেকে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে তিনি দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ), সাধারণ বীমা করপোরেশন, জীবন বীমা করপোরেশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার কাজটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ করে থাকে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ইত্যাদি ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) নিয়োগও এ বিভাগই দেয়; যদিও তাতে শর্ত উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘অনুমোদন সাপেক্ষে’। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফিরিয়ে দেওয়ার নজির নেই বললেই চলে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে নতুন সচিব নিয়োগে সরকারের দুই সপ্তাহের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। এমন দেরির কারণে বিভাগটির আওতায় থাকা সংস্থাগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, বিভাগটিতে নতুন কোনো সচিব আর না-ও নিয়োগ দিতে পারে সরকার। এমনকি বিভাগটি তুলেও দেওয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আগের মতো এটিকে অর্থ বিভাগের একটি অনুবিভাগে পরিণত করা হতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এখন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা। আর পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) সাবেক নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। দুজনই ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকার আমলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একসময় নাম ছিল ব্যাংকিং বিভাগ। ১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের শেষ দিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রথমবারের মতো ব্যাংকিং বিভাগ চালু করা হয়। প্রথম সচিব ছিলেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা। এরপর সচিব হন শাহ আবদুল হান্নান ও সৈয়দ আমীর উল মূলক। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের দুই বছরের মাথায় ১৯৯৮ সালে ব্যাংকিং বিভাগ বাতিল করা হয়। এটি হয় ব্যাংকিং অনুবিভাগ। এরপর ২০০৯ সাল পর্যন্ত এটি অনুবিভাগ হিসেবে কাজ করে।

এক যুগ পর আবার আওয়ামী লীগ সরকারই নতুন করে এ বিভাগ ফিরিয়ে আনে। ২০১০ সালের ৬ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন গঠন করা হয় নতুন বিভাগ। এবার নাম দেওয়া হয় ‘ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ’। গঠনের এক মাস পর, অর্থাৎ ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিনিধিদল সচিবালয়ে বৈঠক করে জানিয়ে গিয়েছিল, বিভাগটি গঠিত হওয়ার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা খর্ব হবে বলে তাদের আশঙ্কা হয়। বিদ্যমান ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ অনুযায়ী, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে যেকোনো নির্দেশনা দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়াত অর্থ উপদেষ্টা আকবর আলি খান তখন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘মুদ্রানীতির ওপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ থাকবে—বিশ্বব্যাপী এটাই রেওয়াজ। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তিশালী থাকলে ব্যাংক খাত নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বেশি কিছু করার থাকে না। ওই দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাংকিং বিভাগ নামে আলাদা বিভাগেরও দরকার পড়ে না।’

বিভাগটি গঠন করার আগে অর্থ বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারীকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আর্থিক খাতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কাজে গতিশীলতা আনার যুক্তি দিয়ে ওই কমিটি তখন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছিল। পরে তৎকালীন মন্ত্রিসভা কমিটি এ প্রস্তাব অনুমোদন করে। বিষয়টি পরে প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির বৈঠকে উত্থাপিত হয়। কারণ, কার্যপ্রণালি বিধিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সম্পর্কে কিছু বলা ছিল না। সচিব কমিটির বৈঠকে কার্যপ্রণালি বিধিমালার সংশোধনী আনা হয়, যা পরে অনুমোদন করে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়।

কোন সচিব কী করে গেলেন

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গঠিত হওয়ার পর প্রথম সচিব হন শফিকুর রহমান পাটোয়ারী। ২০১০ সালের ২১ মার্চ সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত বিভাগটির প্রথম সমন্বয় সভায় তিনি জানিয়েছিলেন, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কর্মসম্পাদন নির্দেশক তৈরি করে দেওয়া হবে এ বিভাগ থেকে। আর তাদের পর্ষদসভার কার্যবিবরণী পাঠাতে হবে এ বিভাগে। শুধু তা–ই নয়, কার্যবিবরণীর সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে থাকতে হবে পর্ষদের নেওয়া উল্লেখযোগ্য বিষয় ও সিদ্ধান্তের সংক্ষিপ্তসার। ওই সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, সচিব বলেছিলেন যে নতুন বিভাগের কার্যপ্রণালি বিধিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের যাবতীয় কার্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তখন এ নিয়ে আপত্তি তুলেছিল।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয় রাজনৈতিক নেতা ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ এ বিভাগ থেকেই করা হয়। শফিকুর রহমান পাটোয়ারী সচিব থাকার সময়ই সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, জনতা ব্যাংকের বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারি হয়। ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসের সময়ও তিনি এ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। দলীয় লোক অর্থাৎ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের পাশাপাশি জাতীয় পার্টির নেতাদেরও রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ দেওয়ার কাজটি তাঁর হাত ধরেই হয়েছিল। বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ দেওয়ার কাজটিও তাঁর সময়েই হয়; যদিও এটা ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

শফিকুর রহমান পাটোয়ারী অবসরে যাওয়ার পর ২০১২ সালের নভেম্বরে এ বিভাগে সচিব হিসেবে আসেন এম আসলাম আলম। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর ২০১৬ সালের মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানের সঙ্গে তাঁকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। তিন বছরের বেশি সময় বিভাগটির সচিব ছিলেন তিনি। ব্যাংকগুলোর পর্ষদে বিতর্কিত, অযোগ্য ও দলীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার ধারাবাহিকতা তাঁর সময়েও বজায় থাকে।

এরপর মার্চ মাসেই বিভাগটিতে সচিব হিসেবে নিয়োগ পান মো. ইউনুসুর রহমান। তাঁর সময়ে ২০১৭ সালের মে মাসে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নাম বদলে রাখা হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। ২০১৮ সালের আগস্টে অবসরে যান তিনি। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে বেসরকারি ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র কায়েমের পথ সুগম হয় তাঁর সময়ে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ দুজন থাকার বিধান ছিল। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে এক পরিবারের চার সদস্যের থাকার সুযোগ দেওয়া হয় পর্ষদে।

ওই বছরের আগস্টে বিভাগটির সচিব হিসেবে যোগ দেন আসাদুল ইসলাম, যিনি প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার একান্ত সচিব ছিলেন। তাঁর চাকরি ছিল এক বছর। ২০১৯ সালে তাঁকে আরও দু বছরের জন্য চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দেয় সরকার। ২০২১ সালের আগস্টে তিনি অবসরে যান। তিনি কিছু আইন সংশোধন ও কিছু নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও বেশির ভাগই শেষ করতে পারেননি।

এরপর আসেন শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ, যিনি পদত্যাগী বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। তিনি অবসরে গেছেন ২০২৪ সালের মে মাসে। তাঁর সময়ে ২০২৩ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন আবার সংশোধন করা হয়। এবার বিস্ময়করভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হয় ব্যাংক পরিচালকদের মেয়াদ। পরিচালকদের মেয়াদ ৯ বছর নিয়েই যেখানে বিশেষজ্ঞদের সমালোচনা ছিল, আইন সংশোধন করে তা করা হয় টানা ১২ বছর। আর শেষে আবদুর রহমান খান এ বিভাগে কাজ করার সুযোগ পান মোটে তিন মাস।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গত ১২ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কারণে ব্যাংক খাতে দ্বৈত শাসনের সুযোগ তৈরি হয়। তাই বিভাগটি বন্ধ করে দিতে হবে। বিভাগটির আওতায় থাকা ব্যাংক ও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্ষদ সদ্য নিয়োগসহ অন্যান্য কাজ তাহলে কে করবে—এমন প্রশ্নের জবাবে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, এসব কাজ তখন অর্থ বিভাগ করবে। প্রতিষ্ঠানটির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমানও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ তুলে দেওয়ার পক্ষে।

বিভাগটি তুলে দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, তা জানতে চাইলে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাজ বেড়েছে। এর সঙ্গে বর্তমানে সম্পর্কযুক্ত রয়েছে অনেক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান। ফলে বিভাগটি তুলে দেওয়ার ব্যাপারে আপাতত কোনো সিদ্ধান্ত নেই।