টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগের সরকার বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণ নিয়েছে। তবে এ সময় তৎকালীন সরকারের বেশি ঝোঁক ছিল দ্বিপক্ষীয় ঋণ নেওয়ার দিকে। মাত্র তিনটি দেশ থেকে মোট বিদেশি ঋণের এক–তৃতীয়াংশ নেওয়া হয়। এসব ঋণের শর্ত কঠিন হলেও প্রকল্প বাস্তবায়নে নজরদারি ও মান দুর্বল থাকে। কিন্তু ঋণ পরিশোধের জন্য কম সময় পাওয়া যায় বলে অর্থনীতি চাপে পড়ে। ঋণ পরিশোধের যে চাপ বাংলাদেশ এরই মধ্যে অনুভব করতে শুরু করেছে।
সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত আগস্টে গণ–আন্দোলনে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতেই তুলনামূলকভাবে বেশি ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। যে তিন দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো ভারত, চীন ও রাশিয়া। দেড় দশকে বাংলাদেশ যত বিদেশি ঋণ নিয়েছে, তার ৩২ শতাংশ অর্থ এসেছে এই তিন দেশ থেকে।
জানা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার ৪৩৮ কোটি ডলার ঋণ ছাড় করেছে গত আওয়ামী লীগ সরকার। এর মধ্যে চীন, রাশিয়া ও ভারত থেকে এসেছে ১ হাজার ৪০১ কোটি ডলার। কর্মকর্তারা মনে করেন, চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে বাছবিচারহীন ঋণ নেওয়ার ফলে দেশের বিদেশি ঋণের বোঝা শুধু ভারী হয়েছে। গত দেড় দশকে মাথাপিছু বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১৬৬ শতাংশ বেড়েছে।
চীন, রাশিয়ার মতো দেশ থেকে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে ঋণ নেওয়া তুলনামূলক সহজ। প্রকল্প বাস্তবায়নে তদারকিও কম থাকে। এতে ঋণ যিনি দেন, তিনি যেমন খুশি থাকেন, যিনি নেন, তিনিও খুশি থাকেন।—সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম
চীন, রাশিয়া ও ভারতের অর্থায়নে বেশ কিছু অবকাঠামো প্রকল্পের বাস্তবায়ন হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পাশাপাশি রেল ও বিদ্যুৎ খাতে ভারত, চীন, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে কঠিন শর্তে ঋণ নেওয়া হয় আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনামলে।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে নেওয়া ঋণগুলোর কিস্তি পরিশোধের সময় সাধারণত কম থাকে। ফলে গ্রেস পিরিয়ড শেষ হলেই ঋণের কিস্তি হিসেবে বড় পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হয়। ইতিমধ্যে চীন ও রাশিয়া থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চীন, রাশিয়া ও ভারতের ঋণ আমাদের চাপে ফেলেছে। ঋণ পরিশোধ বেড়েছে। চাপ যেন বেশি না বাড়ে, সেদিকে নজর দিতে হবে।’
সেলিম রায়হান আরও বলেন, বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতো বহুজাতিক সংস্থার কাছে ঋণ নিলে প্রকল্প বাস্তবায়নে নজরদারি বেশি থাকে এবং এসব ঋণের শর্তও কঠিন হয়। এতে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে আগ্রহ কম থাকে। অন্যদিকে চীন, রাশিয়ার মতো দেশ থেকে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে ঋণ নেওয়া তুলনামূলক সহজ। প্রকল্প বাস্তবায়নে তদারকিও কম থাকে। এতে ঋণ যিনি দেন, তিনি যেমন খুশি থাকেন, যিনি নেন, তিনিও খুশি থাকেন। কারণ, এ ক্ষেত্রে অর্থ লুটপাটের সুযোগ থাকে। বাজারদর থেকে বেশি দামে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সুযোগ থাকে।
কম সুদ ও ঋণ পরিশোধের চাপ কম থাকার কারণে বাংলাদেশ আগে বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ঋণ নেওয়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। দ্বিপক্ষীয় ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পছন্দ ছিল জাপানের প্রতিষ্ঠান জাইকা। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকার মতো সংস্থার কাছ থেকে গতানুগতিক হারেই বিদেশি সহায়তা পেয়েছে। তবে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোর পরিবর্তে চীন, রাশিয়া ও ভারতের দিকেই বেশি ঝুঁকেছিল তৎকালীন সরকার।
বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে চীন ও রাশিয়া দ্রুততার সঙ্গে ঋণ অনুমোদন করলেও এসব ঋণ বাংলাদেশের ঋণের বোঝা বাড়িয়েছে। পাশাপাশি ঋণ পরিশোধে দেশের বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়ার এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলার নিয়েছে বাংলাদেশে। ২০১৬ সালে উভয় পক্ষের মধ্যে এই ঋণচুক্তি হয়। ঋণের অর্থ আসা শুরু হয় ২০১৭ সালে। গত জুন মাস পর্যন্ত এ প্রকল্পের জন্য ৭৩৩ কোটি ডলার ছাড় করা হয়েছে। কিন্তু এই ঋণের বিপরীতে সুদ পরিশোধ শুরু হয়েছে। যদিও রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে ওই অর্থ মস্কোর কাছে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে প্রতিবছর দুই কিস্তিতে ২২ কোটি ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ হিসাবে রাখা হচ্ছে।
চীনা ঋণে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রেল, সড়কসহ বর্তমানে সব মিলিয়ে ১৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এসব প্রকল্পে চীনা ঋণের অবদান এক হাজার কোটি ডলারের মতো। ২০১৭ সালের পর থেকে চীনা ঋণের অর্থ ছাড়ের পরিমাণ বাড়তে শুরু করে। এখন পর্যন্ত চীনা ঋণের ৪৮৭ কোটি ডলার মতো অর্থ ছাড় হয়েছে।
গত দেড় দশকে তিনটি লাইন অব ক্রেডিটে (এলওসি) সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে ৭৩৬ কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত। তবে প্রতিশ্রুতির পরও কাঙ্ক্ষিত হারে অর্থ ছাড় হয়নি। গত জুন মাস পর্যন্ত সব মিলিয়ে ছাড় হয়েছে মাত্র ১৮১ কোটি ডলার। ঋণের অর্থে বাস্তবায়ন করা প্রকল্পগুলোর জন্য বেশির ভাগ কেনাকাটা ভারত থেকে করার শর্ত থাকার কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন ধীর হয়ে পড়ে বলে মনে করেন কর্মকর্তারা।
আওয়ামী সরকারের দেড় দশকে বিদেশি ঋণের বোঝা বেড়েছে সোয়া তিন গুণ। ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, যে বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে, ওই বছর পর্যন্ত (২০০৮-০৯ অর্থবছর পর্যন্ত) দেশের পুঞ্জীভূত বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৮৫ কোটি ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৭৯০ কোটি ডলারে।
বেশি বিদেশি ঋণ নেওয়ায় মাথাপিছু ঋণের বোঝাও বেড়েছে। ২০০৯ সালে মাথাপিছু বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৫০ ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে মাথাপিছু বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০০ ডলার। ফলে দেড় দশকের ব্যবধানে মাথাপিছু বিদেশি ঋণ বেড়েছে ১৬৬ শতাংশ।
বিপুল পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে কয়েক বছর ধরে চাপে রয়েছে দেশের অর্থনীতি। বিশেষ করে দুই বছর ধরে এই চাপ আরও বেড়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো বিদেশি ঋণ পরিশোধ ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের কারণে রিজার্ভ ও বাজেটে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
অর্থনীতির সার্বিক অবস্থার ওপর একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন করতে সরকার যে কমিটি গঠন করেছে, তারা বিদেশি ঋণের আওতায় নেওয়া বড় প্রকল্পগুলো যাচাই–বাছাই করছে। এসব ঋণের শর্ত এবং প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা ও অর্থনৈতিক উপযোগিতা—এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই কমিটিতে প্রতিবেদন তৈরির জন্য ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে।