দেশে এখন থেকে জাতিসংঘের কইকপ পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি গণনা করা হবে। নতুন ব্যবস্থায় পণ্য ও সেবা কমবেশি ২৫% বাড়বে।
দেশের অর্থনীতিবিদেরা দীর্ঘদিন ধরেই মূল্যস্ফীতির হিসাব নিয়ে প্রশ্ন করে আসছেন। মূল্যস্ফীতির তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ ও গণনার পদ্ধতি নিয়েই তাঁদের প্রশ্ন। এখনো ১৭ বছর আগের ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতি গণনা করা হয়। এই দায়িত্ব পালনকারী সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অবশেষে ঘুম ভাঙল। তারা মূল্যস্ফীতি গণনার পদ্ধতি ও ভিত্তি বছর—দুটোই পরিবর্তনের কথা ভাবছে। তিন মাসের মধ্যেই এটি চূড়ান্ত হবে। বিবিএস সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বর্তমানে মূল্যস্ফীতি বেশ আলোচিত বিষয়। দেশে সর্বশেষ গত নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এর আগে গত আগস্ট মাসে তা ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা ১১ বছর ৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এসব হিসাব ২০০৫-০৬ ভিত্তি বছর ধরে তৈরি করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, নিত্যপণ্যের বাজারের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হিসাবে পার্থক্য আছে। প্রকৃত অর্থে মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। এ ছাড়া পুরোনো ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতি গণনা করায় ভোক্তার পরিবর্তিত খরচ প্রবণতা উঠে আসে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন মহলের বলাবলিতে কাজ হয়েছে। মূল্যস্ফীতি হিসাব করতে নতুন ভিত্তি বছর তৈরির উদ্যোগটি প্রশংসনীয়। তিনি আরও বলেন, ‘খাদ্যপণ্যের দাম আমরা কমবেশি জানতে পারি। বিবিএসের সঙ্গে খাদ্যপণ্যের দাম একটু এদিক–সেদিক হলেও প্রবণতা বোঝা যায়। কিন্তু খাদ্যবহির্ভূত পণ্য বা সেবা, যেমন বাসভাড়া, বাড়িভাড়া কোন এলাকার ধরা হয়, তা পরিষ্কার নয়। নতুন গণনার হিসাবে এগুলো পরিষ্কার করা হবে বলে আশা করি।’
বিবিএসের সঙ্গে খাদ্যপণ্যের দাম একটু এদিক–সেদিক হলেও প্রবণতা বোঝা যায়। কিন্তু খাদ্যবহির্ভূত পণ্য বা সেবা যেমন বাসভাড়া, বাড়িভাড়া কোন এলাকার ধরা হয়, তা পরিষ্কার নয়।সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম
তালিকায় পণ্য বাড়ছে ২৫%
দেশে বর্তমানে চাল, ডাল, আটা, ময়দা, তেল, সাবান, লবণ, চিনি, স্বর্ণ, বই, খাতা-কলম, যাতায়াত খরচসহ ৪২৬টি পণ্য ও সেবা দিয়ে মূল্যস্ফীতি গণনা করা হয়। এ ছাড়া ওই তালিকার সব কটি পণ্য ও সেবার ভার ধরা হয় ১০০। প্রতিটি পণ্য ও সেবার জন্য আলাদা করে ভার আছে। দেশের মানুষের সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ খরচ হয় চাল কিনতে।
নতুন ভিত্তি বছরের তালিকায় সোয়া পাঁচ শ থেকে সাড়ে পাঁচ শর মতো পণ্য ও সেবা থাকবে। এতে মূল্যস্ফীতির চিত্র আরও বেশি সুচারুভাবে করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন বিবিএসের কর্মকর্তারা।
২০০৫-০৬ সালকে ভিত্তি বছর ধরার সময় মানুষের হাতে হাতে মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। কিন্তু এখন ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ফলে মোবাইল ডেটা ব্যবহারও বেড়েছে অনেক। তাই মুঠোফোন ব্যবহারকারী বিরাট অংশের নিয়মিত খরচের তালিকায় ইন্টারনেট খরচ ঢুকে গেছে। তাই নতুন তালিকায় ইন্টারনেট খরচ অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। একইভাবে যাতায়াত ও বিনোদন খরচের ভারও বাড়বে। অন্যদিকে ধীরে ধীরে স্বর্ণালংকারসহ গয়নার ব্যবহারও কমেছে। এটি বাদ পড়তে পারে।
নতুন পদ্ধতিতে গণনা
জানা গেছে, এবারে জাতিসংঘ অনুমোদিত ‘ক্ল্যাসিফিকেশন অব ইনডিভিজুয়্যাল কনজাম্পশন অ্যাকর্ডিং টু পারপাস (কইকপ) ২০১৮’ অনুসারে মূল্যস্ফীতি গণনা করবে বিবিএস। কইকপ পদ্ধতিতে এক ভোক্তার চাহিদা অনুসারে খরচের প্রবণতা ধরে মূল্যস্ফীতি হিসাব করা হয়।
বিবিএসের কর্মকর্তারা জানান, নতুন নিয়মে মূল্যস্ফীতি গণনার প্রক্রিয়ায় ২০১৬-১৭ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ থেকে মানুষের খরচের প্রবণতা বিবেচনা করা হয়েছে। সেখান থেকে পণ্য ও সেবার প্রাথমিক তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এই তালিকায় প্রায় সাড়ে পাঁচ শ পণ্য ও সেবা নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে এসব পণ্য ও সেবার ২০২১-২২ অর্থবছরের সারা বছরের গড় মূল্য ধরে ভার দেওয়া হয়েছে। এর মানে, পণ্য ও সেবার মূল্য হালনাগাদ থাকবে। যেহেতু ২০২২ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ শেষ হয়নি। তাই পাঁচ বছরের জরিপের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে বিবিএসকে।
চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরের শুরুতেই মূল্যস্ফীতির নতুন ভিত্তি বছর তৈরির কাজ শুরু করেছে বিবিএসের জাতীয় আয় শাখা। গত আগস্ট মাস থেকে মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করলে নতুন ভিত্তি বছর তৈরির চাপ বাড়তে থাকে। অর্থনীতিবিদেরা সমালোচনা করেন যে পুরোনো ভিত্তি বছরে মূল্যস্ফীতি গণনার কারণে প্রকৃত চিত্র আসছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিবিএসের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে মূল্যস্ফীতি গণনার পদ্ধতি, পণ্য ও সেবার তালিকা এবং ভার ঠিক করা হয়েছে। নীতিনির্ধারকদের অনুমোদন পেলেই আগামী মার্চ মাস বা আগামী ২০২৩–২৪ অর্থবছর থেকে নতুন ভিত্তি বছরে মূল্যস্ফীতি গণনা করা হবে।