দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে ভ্যাট–বৈষম্য রয়েছে। গুটিকয় ব্যবসায়ী ভ্যাট দিলেও অধিকাংশই দেন না। এ জন্য যাঁরা ভ্যাট দিচ্ছেন, তাঁদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমছে। নতুন করে ভ্যাট বাড়ানোয় এই ব্যবসায়ীরাই বেশি চাপে পড়ছেন। আর যেসব ব্যবসায়ী ভ্যাট দিচ্ছেন না, তাঁদের ধারেকাছেও যেতে পারছে না সরকার। তাই ভ্যাট–বৈষম্যের অবসান হওয়া দরকার।
‘ভোক্তার কাঁধে বাড়তি করের বোঝা: উত্তরণে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় ব্যবসায়ীরা এ কথাগুলো বলেন। নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ ২৪ ডটকম আয়োজনে এই গোলটেবিল গতকাল বুধবার রাজধানীর গুলশানের এমসিসিআই সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। এতে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী, অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ, নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রমুখ।
কর–ভ্যাটের হার যুক্তিযুক্ত করা হলে দেশ সুন্দরভাবে চলবে বলে মন্তব্য করেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী। তিনি বলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে কর্মসংস্থান ও রাজস্ব বাড়াতে ব্যবসায়ীদের দরকার আছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ বাড়াতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
খাদ্যপণ্যকে ভ্যাটমুক্ত রাখার দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ অটো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘কর–ভ্যাটের জাঁতাকলে বিস্কুটের প্যাকেট আর কত ছোট করব আমরা? প্যাকেটে বিস্কুটের পরিমাণ আর কত কমাব? এভাবে ছোট আর কমাতে কমাতে খালি প্যাকেট দিতে হবে।’ তিনি বলেন, নিত্যপণ্যে যদি ভ্যাট থাকে, তাহলে মানুষ কোথায় মুক্তি পাবে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া অর্থনৈতিক নীতিগুলোর একটা সাধারণ ধরন রয়েছে। সেটা হচ্ছে, ভুল সময়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া। জানি না, সেটি কেন হচ্ছে।—মুস্তফা কে মুজেরী, সাবেক মহাপরিচালক, বিআইডিএস
ব্যবসা-বাণিজ্যে ভ্যাট–বৈষম্য দূর করলে সরকারের রাজস্ব অভাব হবে না বলে মনে করেন সুপারমার্কেট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন। তিনি বলেন, সুপারশপে পণ্য কিনলেই ক্রেতাদের ভ্যাট দিতে হয়। অথচ পাশের মুদিদোকানে ভ্যাট নেই। তাহলে সুপারশপে আসায় মানুষের কী দোষ হয়েছে।
বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা) এম এ হাশেম বলেন, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক আরোপের ফলে দাম বেড়ে গেলে পণ্য কেনা কমিয়ে দেবেন ভোক্তারা। স্বাভাবিকভাবে কোম্পানিগুলোও কাঁচামাল হিসেবে কৃষিপণ্য সংগ্রহ কমিয়ে দেবে। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষকেরা। তাঁরা ফসলের ভালো দাম পাবেন না। তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংকঋণের সুদের হার ১৬-১৭ শতাংশ হয়ে গেছে। দিনে গড়ে আট ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। গ্যাসেরও সংকট আছে। সব মিলিয়ে আমরা যারা শিল্পকারখানা করেছি, তারা আছি বিপদে।’
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ভুল সময়ে ভুল নীতি নিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী। তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার ছয় মাস পূর্ণ করল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার মনে হয়, অর্থনীতিতে সফলতা নেই বললেই চলে। সরকারের নেওয়া অর্থনৈতিক নীতিগুলোর একটা সাধারণ ধরন রয়েছে। সেটা হচ্ছে, ভুল সময়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া। জানি না, সেটি কেন হচ্ছে। তার একটা বড় উদাহরণ, অর্থবছরের মাঝপথে ভ্যাটের হার বাড়ানো। এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত, ভুল সময়ে নেওয়া হয়েছে।’
অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে মুদ্রানীতি এককভাবে কোনো ফলাফল আনতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার ১০ শতাংশে উঠিয়ে রেখেছে। এটি মূল্যস্ফীতিতে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। মূল্যস্ফীতি তার নিজের গতিতে চলছে। এতে বরং দেশের কিছুটা ক্ষতি হচ্ছে। ব্যাংকঋণের সুদের হার বেড়ে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, বর্তমান সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল দ্রব্যমূল্য কমানো। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও যখন সেটি করা গেল না, তখন শুল্ক কমানো হলো। তবে নিত্যপণ্যের দাম তো কমলই না, উল্টো সরকারের রাজস্ব–ঘাটতি হলো। তখন আইএমএফ বলল, রাজস্ব–ঘাটতি থাকলে চতুর্থ কিস্তি তারা দেবে না। এ পরিস্থিতিতে সরকার বিভিন্ন পণ্যে ভ্যাট বাড়িয়ে দিল। এসব পণ্যের দাম বাড়লে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের ওপর চাপ পড়ে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য, ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে কর প্রশাসন অটোমেশন করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। সংস্কারে যেন কর প্রশাসনের কোনো আগ্রহ নেই। এখানে ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত থাকতে পারে। নিজেদের এমন অসংগতি দূর করতে না পারলে কিংবা নিয়মের প্রতিপালন করতে না পারলে কর আদায় বাড়বে না।’
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে রাজস্ব খাতে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের প্রত্যাশা করেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের উদ্যোগ নিলে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারবে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, ‘বিশ্বের কোথাও হার বাড়িয়ে কর আদায় বাড়ানো যায়নি। আমাদের গবেষণায় এসেছে, করভার ২০ শতাংশ কমানো গেলে বাংলাদেশের মতো দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ ১৪ গুণ বাড়বে। তাতে সরকারের রাজস্ব সাড়ে ছয় গুণ বাড়তে পারে।’
জাগোনিউজের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কে এম জিয়াউল হকের সঞ্চালনায় গোলটেবিলে বক্তব্য দেন রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য রেজাউল হাসান, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ, তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল, এসিআই ফুডসের প্রধান ব্যবসা কর্মকর্তা ফারিয়া ইয়াসমিন, এসএমসি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফ উদ্দিন নাসির, ইআরএফ সভাপতি দৌলত আকতার মালা প্রমুখ।