চট্টগ্রামের ১৯টি কনটেইনার ডিপোতে রপ্তানির অপেক্ষায় ৮৭০০ কনটেইনার পণ্য।
পাঁচ-সাত দিনের বিলম্বে পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। জরুরি পণ্য পাঠানো হচ্ছে উড়োজাহাজে।
চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ভেড়ানোর জন্য গত এক বছরে গড়ে প্রতিটি কনটেইনার জাহাজকে একদিন সাগরে অপেক্ষা করতে হতো। আবার অপেক্ষা ছাড়াই সরাসরি জেটিতে ভেড়ানোর অনেক নজিরও ছিল এ সময়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রভাবে এই স্বাভাবিক অবস্থা এখন নেই। যেমন গতকাল বুধবার বন্দর জেটিতে যে দুটি জাহাজ ভিড়েছে, সেগুলো বন্দরের জলসীমায় পৌঁছেছিল চার দিন আগে।
বন্দর জেটিতে ভেড়ানোর জন্য গতকাল মোট ১৩টি কনটেইনার জাহাজ সাগরে অপেক্ষা করছিল। কোনোটি পাঁচ দিন, কোনোটি তিন-চার দিন অপেক্ষা করছে। জাহাজ অপেক্ষার সময় বাড়ার অর্থ হলো আমদানি পণ্য বা শিল্পের কাঁচামাল হাতে পেতে দেরি হওয়া। শিল্পের কাঁচামাল হাতে পেতে দেরি হলে উৎপাদন বিলম্ব হয়। বিশেষ করে তৈরি পোশাকের মতো জরুরি আমদানি চালানের পণ্য হাতে পেতে দেরি হলে সময়মতো রপ্তানি নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। কারণ, তৈরি পোশাকের পণ্য উৎপাদনের সময় সুনির্দিষ্ট থাকে। উৎপাদনের আগেই চার-পাঁচ দিন চলে যাচ্ছে পণ্য হাতে পেতে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে বন্দর-কাস্টম হাউসে অচলাবস্থা কাটলেও রপ্তানি কনটেইনারের স্তূপ বাড়ছে ডিপোতে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ, এরপর ইন্টারনেট বন্ধ এবং কারফিউর কারণে প্রায় এক সপ্তাহ আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম যে ব্যাহত হয়েছিল, তার প্রভাবে বন্দরে এখন এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। বন্দর কার্যক্রম দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা অর্থাৎ পুরোদমে চললেও চাপ কমছে না। কারণ, সমুদ্রপথে সারা দেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ৮৭ শতাংশ আনা-নেওয়া হয় এই বন্দর দিয়ে। ফলে এই বন্দরের ওপর চাপ বেশি।
আমদানির মতো পণ্য রপ্তানিতেও বিলম্ব হচ্ছে। কারণ, সারা দেশের কারখানাগুলোয় আটকে পড়া রপ্তানি পণ্য আসতে শুরু করেছে এসব ডিপোতে।
এতে রপ্তানি পণ্য ব্যবস্থাপনার চাপ উল্টো বেড়েছে বেসরকারি ১৯টি ডিপোতে। আন্দোলন-সংঘাতের চেয়ে ইন্টারনেট বন্ধ রাখার কারণে বেশি প্রভাব পড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
বেসরকারি ডিপো সমিতির হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন বন্দর দিয়ে গড়ে দুই হাজার একক কনটেইনার পণ্য রপ্তানি হয়। গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামের ১৯টি ডিপোতে রপ্তানি পণ্য ছিল ৮ হাজার ২০০ একক কনটেইনার। গতকাল বুধবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৭০০ একক কনটেইনার। এসব রপ্তানি কনটেইনার জাহাজে তুলে দেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। প্রতিদিন রপ্তানি কনটেইনার বন্দর দিয়ে জাহাজে তুলে দেওয়া হলেও চাপ কমছে না। কারণ, কারখানা থেকে নতুন নতুন রপ্তানি চালানের গাড়ি আসছে ডিপোতে, সেগুলো আবার কনটেইনারে বোঝাই হচ্ছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি কনটেইনার ডিপো সমিতির মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে প্রায় এক সপ্তাহ ঢাকার কারখানাগুলো থেকে রপ্তানি পণ্য তেমন আসেনি। আবার ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় অন্তত এক সপ্তাহ শুল্কায়নও ব্যাহত হয়েছে। এক সপ্তাহের কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার প্রভাব পড়েছে বেসরকারি ডিপোগুলোয়। এই জট খুলতে অন্তত ১০-১৫ দিন সময় লাগবে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সংঘর্ষ চূড়ান্ত রূপ নিলে গত ১৭ জুলাই থেকে ঢাকার কারখানাগুলো থেকে রপ্তানি পণ্য চট্টগ্রামের ডিপোগুলোতে পাঠানো ব্যাহত হয়। এর এক দিন পর সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দিলে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে অচলাবস্থা তৈরি হয়। কারণ, বন্দর ও কাস্টমসের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম অনলাইনে হয়। টানা চার দিন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে নতুন কোনো আমদানি চালান খালাস বা রপ্তানি চালান জাহাজে তুলে দেওয়ার জন্য শুল্কায়ন করা যায়নি।
গত ২৩ জুলাই থেকে বিকল্প ব্যবস্থায় কাস্টম হাউসের অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নতুন চালান শুল্কায়নের জন্য নথিপত্র জমা নেওয়া শুরু হয়। এরপর সীমিত আকারে ইন্টারনেট-সুবিধা চালু হয়। তাতে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে কিছুটা গতি বাড়ে। তবে ইন্টারনেট ধীরগতির কারণে এসব কার্যক্রম পুরো স্বাভাবিক হয়নি। শুল্কায়ন না হলে বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমও করা যায় না। সব মিলিয়ে প্রায় এক সপ্তাহ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ব্যাহত হওয়ার চাপ এখন পড়ছে।
এ সময় পোশাক খাতের বিপুলসংখ্যক চালান সময়মতো রপ্তানি করা যায়নি। আবার নির্ধারিত সময়ে ক্রেতার হাতে তুলে দিতে চট্টগ্রাম থেকে চালান ফেরত নিয়ে উড়োজাহাজে রপ্তানি করারও ঘটনা ঘটেছে। যেমন তুসুকা গ্রুপ ৮০ হাজার পিস তৈরি পোশাক নিজস্ব খরচে উড়োজাহাজে করে ইউরোপে পাঠিয়েছে। এ বিষয়ে তুসুকা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরশাদ জামাল প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত উড়োজাহাজে পণ্য পাঠাতে ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে।
আবার সময়মতো পণ্য রপ্তানি না হওয়া অনেক চালান এক সপ্তাহ বিলম্বে জাহাজে তোলা হচ্ছে। যেমন চট্টগ্রামের আরডিএম গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইউনি গার্মেন্টস লিমিটেড প্রায় তিন লাখ পিস তৈরি পোশাকের দুটি চালান রপ্তানি করার কথা ছিল গত ২২ ও ২৫ জুলাই। উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে চালান দুটি সময়মতো রপ্তানি করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
জানতে চাইলে আরডিএম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও তৈরি পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমএ সহসভাপতি রকিবুল আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আটকে থাকা চালান দুটি গত সোমবার রপ্তানি হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় এখন রপ্তানি পণ্য ডিপোতে পাঠানো হচ্ছে। তাতে ডিপোতে রপ্তানি পণ্যের চাপ বেড়েছে।