আটটি ফাস্ট ট্র্যাক বা অগ্রাধিকার প্রকল্পের চারটির মেয়াদ ও খরচ বেড়েছে। ডলার–সংকটে আমদানি জটিলতা বাড়ছে। নির্বাচন সামনে রেখে তদারকি বেড়েছে।
অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলো সময়মতো শেষ হবে। বাড়তি টাকা লাগবে না। দেশের মানুষ উপকৃত হবে। অর্থনীতিতে দারুণ অবদান রাখবে এসব প্রকল্প। এমন প্রত্যাশায় সরকার আটটি ফাস্ট ট্র্যাক বা অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
কিন্তু এসব প্রকল্প এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। ইতিমধ্যে চারটি প্রকল্পের মেয়াদ ও খরচ বেড়েছে। প্রকল্পগুলো হলো পদ্মা সেতু, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ ও কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণ প্রকল্প। বাকি চার প্রকল্পও নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
ডলার–সংকটের কারণে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পণ্য আমদানিও জটিলতায় পড়েছে। আর মেট্রোরেল প্রকল্পের মেয়াদও বাড়তে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বড় অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, মৌলিক দুর্বলতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না বড় প্রকল্পগুলো।
সম্পদের কথা চিন্তা না করেই এসব প্রকল্প নেওয়া হয়। শুধু টাকা নয়, এই ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ মানবসম্পদের অভাব আছে। তিনি আরও বলেন, প্রথমে কম বাজেট দিয়ে প্রকল্প পাস করা হয়। ফলে প্রকৃত ঠিকাদারেরা অংশ নেন না। তাঁরা জানেন, এত কম দামে কাজ করা যাবে না। এর ফলে নিম্নমানের ঠিকাদার দিয়ে নিম্নমানের কাজ হয়। পরে প্রকল্পের খরচও বাড়ানো হয়।
বড় প্রকল্পগুলো থেকে রাজনৈতিক সুবিধা পেতে চায় প্রায় সব ক্ষমতাসীন দল। বড় বড় প্রকল্প দেখিয়ে জনগণের মন জয় করতে চায় তারা। ভোটের বাজারে কিংবা জনপ্রিয়তায় বিরোধী দলের চেয়ে এগিয়ে থাকতেই এটা করা হয়।
দেশে ২০২৪ সালের প্রথম ভাগেই জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। সেই অনুযায়ী, বড় প্রকল্প নিয়ে প্রস্তুতিও নিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল। ইতিমধ্যে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলোর কাজের গতি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রতি চার মাস অন্তর দেশের আটটি ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প পরিদর্শনের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে এক দফা পরিদর্শন হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইএমইডি সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলো নিবিড়ভাবে তদারকিতে রাখা হচ্ছে। চার মাস পরপর আমরা দেখছি, অগ্রগতি কতটা হলো। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোথাও কোনো সমস্যা হলে তা সঙ্গে সঙ্গে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। বিশেষ করে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ ছাড়ে গতির আনার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।’
অগ্রাধিকার প্রকল্পের বেশ কয়েকটি ডলার–সংকটে ভুগছে। ডলার–সংকটে ঠিকাদারকে অর্থ পরিশোধেও সমস্যা হচ্ছে। আবার আমদানি করে জিনিসপত্র আনতে ঋণপত্র বা এলসি খোলার ক্ষেত্রেও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ঠিকাদারদের। এই তালিকায় আছে রাজধানীর মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা বহুমুখী সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প।
জানা গেছে, চার মাস ধরে ঠিকাদারের প্রতি মাসের ইনভয়েসের (ডলার অংশ) পুরোটা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। গত চার মাসের প্রতি মাসে ৪০ থেকে ৫০ লাখ ডলারের ইনভয়েস (বিল) দিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তার বিপরীতে অর্ধেকের মতো বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
এ নিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্প কার্যালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে একাধিক চিঠি দিয়ে তাগিদ দেওয়া হলেও কাজ হয়নি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জিনিসপত্র আমদানি করতে পর্যাপ্ত ডলার মিলছে না। কয়েক লাখ ডলারের ঋণপত্র ঝুলে আছে। একই সমস্যা মেট্রোরেল প্রকল্পেও।
আটটি অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পই সবচেয়ে এগিয়ে আছে। ইতিমধ্যে সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। এখন রেল সংযোগের কাজ চলছে। সার্বিকভাবে গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত সাড়ে ৯৪ শতাংশ বা ২৮ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ৩০ হাজার ১৮৩ কোটি টাকার প্রকল্পটি এই পর্যন্ত দুবার সংশোধন করে মেয়াদ ও খরচ বাড়ানো হয়েছে। ২০০৯ সালে প্রকল্পের মেয়াদ শুরু হয়।
১৮ হাজার ২১০ কোটি টাকার পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটির মাধ্যমে দক্ষিণ অঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর রেল যোগাযোগ তৈরি করা হচ্ছে। ২০১৬ সালে প্রকল্পটি শুরু হয়। ৮ বছরে ৬৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। দেড় বছরে বাকি কাজ শেষ করতে হবে। অবশ্য ইতিমধ্যে প্রকল্পটির সময় ও খরচ বাড়ানো হয়েছে।
ঢাকায় যানজট কমাতে ও যাত্রীদের দ্রুত চলাচলের জন্য ২০১২ সালে উত্তরা থেকে মিরপুর, ফার্মগেট হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়। এক দফা খরচ বাড়িয়ে এখন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন হার ৬১ শতাংশ। চলতি মাসেই উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশে মেট্রোরেল চালুর কথা আছে। ২০২৪ সালে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
দেশের সর্ববৃহৎ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের খরচ ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। অর্ধেক টাকা খরচ হয়েছে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকল্পটি শেষ করার কথা আছে। ৮ বছরে মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের অগ্রগতি ৫৬ শতাংশ। আগামী চার বছরে বাকি কাজ শেষ করতে হবে।
পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পটি দুবার সংশোধনের পর খরচ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এই পর্যন্ত ৮২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী ছয় মাসে বাকি কাজ শেষ করতে হবে।
কক্সবাজারে রেলে যাবেন পর্যটকেরা। এ জন্য চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প। প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পের মেয়াদ শুরু হয় ২০১০ সালে। কিন্তু জমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত নানা জটিলতায় কাজ শুরু করতেই চার-পাঁচ বছর চলে যায়। এক দফা প্রকল্প সংশোধন করা হয়। ২০২৪ সালের জুন মাসে রেলপথ নির্মাণের কাজ শেষ হবে। এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৩৯ শতাংশ অর্থ।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাইরে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। ১৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটির এই পর্যন্ত ৮২ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকল্পটি শেষ করার কথা আছে।