বাজার
বাজার

পরিস্থিতির প্রভাব

সংকটের অর্থনীতি আরও চাপে পড়ে গেল

• উচ্চ মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে
• রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কমার আশঙ্কা
• ক্ষয়িষ্ণু বৈদেশিক রিজার্ভের ওপর চাপ পড়বে
• ব্যবসা-বাণিজ্যে শ্লথগতি, শুল্ক-কর কীভাবে আসবে
• সবচেয়ে বেশি বিপাকে ছোট ব্যবসায়ীরা

এক বছর আগে থেকে দেশের অর্থনীতির প্রায় সব সূচক খারাপ হতে শুরু করে। মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়, রপ্তানি আয় ও শুল্ক-কর কোনো সূচকেই স্বস্তি নেই। সার্বিক অর্থনীতিই ধীরে ধীরে সংকটের মধ্যে পড়ছিল। তিন সপ্তাহ ধরে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংঘাত, প্রাণহানি ইত্যাদি সংকট অর্থনীতিকে আরও চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এতে বিনিয়োগ কমতে পারে, থমকে যেতে পারে অর্থনীতির চাকা।

অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, চলমান সহিংসতা বন্ধ না হলে দেশের অর্থনীতি আরও গভীর সংকটের মধ্যে পড়ে যেতে পারে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপত্তা ও রাজনীতি ঠিক না হলে দেশের অর্থনীতিও ঠিক হবে না। চলমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতি বাঁচাতে রাজনৈতিক সমাধান অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।

মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির আশঙ্কা

চলমান রাজনৈতিক সংকটে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশের অর্থনীতিবিদেরা। খাদ্যপণ্যের সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় বাজারে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়তে পারে।

দেশে এক বছর ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি খারাপ অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত ১২ মাসের মধ্যে ৭ মাসই খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। গত বছরের আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে উঠেছিল, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সর্বোচ্চ।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ, যা অর্থবছরওয়ারি হিসাবে অন্তত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। পুরো বছরে কোনো মাসেই সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের নিচে নামেনি।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, গত কয়েক সপ্তাহের অনিশ্চয়তায় অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছে। পণ্য পরিবহন প্রায় বন্ধই ছিল। শ্রমজীবী মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন, তাঁদের রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে।

ক্ষয়িষ্ণু রিজার্ভ ঠেকাবে কে

বর্তমানে অর্থনীতির অন্যতম বড় সংকট হলো ক্ষয়িষ্ণু রিজার্ভ। গত এক বছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত প্রায় ১ হাজার কোটি ডলারের মতো কমেছে। মার্কিন ডলারের জোগান বাড়িয়ে রিজার্ভের পতন ঠেকাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ঋণসহায়তা নিয়েছে সরকার। তাতে অবশ্য রিজার্ভ তেমন বাড়েনি। প্রবাসী আয় আর রপ্তানি আয়েও বড় কোনো অগ্রগতি নেই।

আইএমএফের গণনাপদ্ধতি অনুসারে গত জুলাই মাস শেষে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৮ কোটি ডলার, যা এক বছর আগে ৩ হাজার কোটি ডলারের বেশি ছিল।

এদিকে দেশে ডলারের দামও বাড়তি। ১১৮ টাকা দরে ডলার কিনে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। ফলে রিজার্ভের মজুত থেকে বেশি ডলার খরচ হচ্ছে। ডলারের জোগানের অন্যতম উৎস প্রবাসী আয় তেমন বাড়েনি।

নিরাপত্তা ও রাজনীতি ঠিক না হলে দেশের অর্থনীতিও ঠিক হবে না। চলমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতি বাঁচাতে রাজনৈতিক সমাধান অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে
আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই।

এ নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ দেওয়া হলো। তিন দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হলো। ব্যাংক বন্ধ থাকবে, রেমিট্যান্স আসবে কীভাবে? এ পরিস্থিতিতে রপ্তানিও ব্যাহত হচ্ছে। তাহলে রিজার্ভ কীভাবে বাড়বে? তাঁর মতে, রিজার্ভ কমে যদি আরও তিন-চার বিলিয়ন ডলার কমে যায়, তাহলে অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।

জুলাই মাসে আগের ১০ মাসের তুলনায় সবচেয়ে কম প্রবাসী আয় এসেছে। প্রবাসীদের মধ্যে দেশে রেমিট্যান্স না পাঠানোর একটি জোরদার প্রচারণাও চলছে। আবার রপ্তানি আয়ের হিসাব নিয়েও গরমিল আছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের রপ্তানি হিসাবের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে প্রায় ৯ বিলিয়ন বা ৯০০ কোটি ডলারের তফাত আছে।

রাজস্ব আদায় কি থমকে যাবে

সরকারের খরচের জোগানের অন্যতম বড় উৎস শুল্ক-কর। ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিকভাবে চললে শুল্ক-কর আদায় নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতে হয় না। শুল্ক-করের দুই-তৃতীয়াংশ তো আসে শুল্ক-কর থেকে। কিন্তু জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে অনিশ্চয়তা ও সংঘাত চলমান আছে। এর মধ্যে সরকারি ছুটি ছিল, কারফিউ চলছে। এমন অবস্থায় আমদানি পণ্য খুব খালাস হয়নি। আবার স্থানীয় পর্যায়ে দোকানপাট তেমন একটা খোলেনি। খুললেও বেচাকেনা তেমন নেই।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, গত জুলাই মাসের চূড়ান্ত হিসাব আসেনি। তবে এনবিআরের কর্মকর্তারা মনে করেন, শুল্ক-কর আদায় আগের বছরের জুলাই মাসের তুলনায় অর্ধেকে নামবে। গত বছর জুলাই মাসে ২০ হাজার কোটি ৬০০ কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় করেছিল এনবিআর।

এ বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে না। তাহলে ব্যবসায়ীরা শুল্ক-কর কীভাবে দেবেন?

ছোট ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত

তিন সপ্তাহ ধরে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন। ব্যাপক সহিংসতাও হয়েছে। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ, সাধারণ ছুটি ঘোষণাসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু সহিংসতা ও রাস্তাঘাট অবরোধ কমেনি। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ছোটখাটো ব্যবসায়ীরা।

বিশেষ করে ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা দোকান খুলতে পারেননি। রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা তাঁদের প্রতিষ্ঠান খুলতে পারেননি। বেশির ভাগ সময় দোকানপাটও বন্ধ ছিল।

এ নিয়ে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ছোট ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বড় ব্যবসায়ীরা তাঁদের ক্ষতি কোনো না কোনোভাবে পুষিয়ে নিতে পারবেন, কিন্তু ছোট ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা অনেকটা দিন আনেন দিন খান। তাঁদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তাঁরা কর্মচারীদের বেতন–ভাতা দিয়ে পোষাতে পারবেন না।

আশকোনার হাজিক্যাম্প এলাকায় ১১ বছর ধরে শাকসবজির ব্যবসা করেন রফিকুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে শাকসবজি কম আসছে। ফলে ব্যবসায় মন্দা। কারণ, আতঙ্কে ক্রেতারা খুব বেশি আসছেন না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, দেশে ২৫ লাখের বেশি খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ী আছেন। তাঁদের বেশির ভাগেরই জীবিকা এখন হুমকির মুখে।