দেশের কোনো করদাতা আয়কর নথিতে বিদেশে থাকা তাঁদের বাড়ি-গাড়িসহ সম্পদের কোনো তথ্য দেননি। দুই বছর আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর বিদেশে থাকা সম্পদ আয়কর নথিতে দেখানোর সুযোগ তৈরি করে; কিন্তু এ সুযোগ কেউ নেননি।
আয়কর নথিতে না দেখালেও দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলাদের অনেকের দেশের বাইরে বাড়ি, গাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাবর সম্পদ রয়েছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এসব সম্পদ নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হচ্ছে। তা সত্ত্বেও কর কর্মকর্তারা বিদেশে থাকা সম্পদের বিষয়ে কোনো খোঁজখবর নিচ্ছেন না।
স্বাধীনতার পর বিগত ৫০ বছরে কখনো আয়কর নথিতে বিদেশি সম্পদ দেখানোর সুযোগ রাখেনি এনবিআর। ২০২২ সালে বাজেট ঘোষণার সময় প্রথমবারের মতো এই সুযোগ রাখা হয়। পাশাপাশি ওই বছর ঘোষিত বাজেটে এক বছরের জন্য বিদেশে পাচার করা অর্থ বিনা প্রশ্নে নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে দেশে আনার সুযোগ দেওয়া হয়; কিন্তু ওই সুযোগও কেউ নেননি।
দেশ থেকে পাচার করা অর্থ দিয়েই অনেকে বিদেশে সম্পদ গড়েছেন। এসব সম্পদ আয়কর নথিতে দেখালে ভবিষ্যতে ঝামেলায় পড়তে পারেন, তাই তাঁরা তা কর নথিতে উল্লেখ করেন না—জাহিদ হোসেন, সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়
এরই মধ্যে দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যম সাবেক মন্ত্রীসহ রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের বিদেশে বাড়ি-গাড়িসহ নানা ধরনের সম্পদ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। এই তালিকায় আছেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম (সাইফুল আলম) ও তাঁর পরিবারের সদস্য, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য মো. আবদুস সোবহান মিয়া (গোলাপ), বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ও তাঁর পরিবার, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ, সাবেক পুলিশপ্রধান বা আইজিপি বেনজীর আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হারুন উর রশীদ, বিতর্কিত ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিজ সরাফাত প্রমুখ। এসব ব্যক্তির নামে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। এনবিআরের কর বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উল্লেখিত ব্যক্তিদের আয়কর নথিতে বিদেশে থাকা সম্পদের কোনো তথ্য নেই।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আয়কর নথিতে বিদেশে থাকা সম্পদ দেখানোর সুযোগ দিয়েও লাভ হলো না। মূলত দেশ থেকে পাচার করা অর্থ দিয়েই অনেকে বিদেশে সম্পদ গড়েছেন। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ নিরাপদ রাখার জন্য বিদেশে নিয়ে গেছেন। বিদেশে থাকা সম্পদ আয়কর নথিতে দেখালে ভবিষ্যতে ঝামেলায় পড়তে পারেন, তাই তাঁরা তা কর নথিতে উল্লেখ করেন না।
২০১৯ সালের শেষের দিকে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন ভুঁইয়ার সময়ে বিদেশে থাকা সম্পদ ঘোষণার বিধানটি রেখে সেই সম্পদের বিপরীতে কর আদায়ের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে আইনি জটিলতা দেখা দিতে পারে—এই যুক্তিতে পরে তা বাতিল হয়ে যায়।
এনবিআরের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউস ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবু হেনা মো.রহমাতুল মুনিম—এই তিনজন বিদেশে থাকা সম্পদ দেখানো ও ফিরিয়ে আনার জন্য আয়কর আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেন। কয়েকজন ব্যবসায়ী পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ওই তিন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা এ বিষয়ে দূতিয়ালি করেন। ব্যবসায়ীদের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে আয়কর আইন পরিবর্তন করা হলেও পরে ওই ব্যবসায়ীরা অর্থ ফিরিয়ে আনতে উৎসাহ দেখাননি।
এনবিআরের কাছে বার্ষিক কর নথি জমা দেওয়ার সময় একজন করদাতাকে আয়কর, ব্যয় ও সম্পদ—এই তিন ধরনের তথ্য দিতে হয়। এর মধ্যে আয় বিবরণীতে কোন কোন খাত থেকে কত আয় হয়েছে, তা উল্লেখ করতে হয়। ১০(বি) ফরমে সম্পদের বিবরণী দিতে হয়। দেশে-বিদেশে ৫০ লাখ টাকার বেশি সম্পদ থাকলে সম্পদের বিবরণী দাখিল করা বাধ্যতামূলক। ১০(বি) ফরমের ৯ নম্বর কলামে বিদেশে থাকা সম্পদের পরিমাণ লেখার ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে দেশে এক কোটির বেশি কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) আছেন। তাঁদের মধ্যে ৩৫ লাখের বেশি রিটার্ন জমা দেন।
কর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশ কয়েকটি কারণে বিদেশে থাকা সম্পদ দেখাতে উৎসাহিত হন না করদাতারা। প্রথমত, একই সম্পদের ওপর দ্বৈত কর আরোপ হয়ে যেতে পরে। দ্বিতীয়ত, পাচার করা অর্থে কেনা সম্পদ দেখানো হলে সরকারের অন্য সংস্থা (যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক) ধরতে পারে। তৃতীয়ত, বিদেশে অর্জিত আয়ের সম্পদ বিদেশে থাকা কর নথিতে দেখানো বেশি নিরাপদ এবং দেশের কর নথিতে দেখানোর বাধ্যবাধকতা নেই।
এ ছাড়া বাংলাদেশি বড় বড় কোম্পানির বিদেশে আউটলেট ও অফিস আছে। আবার বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিজ দেশে সম্পদ আছে। এসব সম্পদ দেখাতে পারেন সংশ্লিষ্ট করদাতারা।
পারিবারিক বা বিনিয়োগের সূত্রে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মালয়েশিয়াসহ বহু দেশে নাগরিকত্ব নিয়েছেন বা স্থায়ীভাবে বসবাস করেন বহু বাংলাদেশি। এর মধ্যে মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচির আওতায় বহু বাংলাদেশি ওই দেশে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ নিয়েছেন। সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে এই পর্যন্ত ৩ হাজার ৬০৪ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় আবাস গড়েছেন।
একইভাবে কানাডা ও সিঙ্গাপুরে বিনিয়োগ কর্মসূচির মাধ্যমেও স্থায়ী হওয়ার সুযোগ নিয়েছেন অনেক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী। আমদানি-রপ্তানির আড়ালে এবং হুন্ডিসহ নানা উপায়ে ওই সব দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে। আমলাদের একটি বড় অংশও অবৈধ উপার্জিত অর্থ পাচার করে অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছে।
দ্বৈত নাগরিকদের কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার নিয়ে বিপাকে থাকা অনেক দেশ বিদেশে থাকা সম্পদ জানা এবং কর আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছে। সার্কভুক্ত দেশ ভারত ও পাকিস্তানের কর নথিতে আগে বিদেশি সম্পদ দেখানোর কোনো সুযোগ ছিল না। ২০১৯ সালে দুটি দেশই তাদের নাগরিকদের বিদেশে থাকা সম্পদ কর নথিতে দেখানোর বিশেষ সুযোগ দিয়েছে।
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভারতীয় নাগরিকদের বিদেশে থাকা সম্পদ তাঁদের কর নথিতে দেখানোর সুযোগ দেয় ভারতের দ্য সেন্ট্রাল বোর্ড অব ডিরেক্ট ট্যাক্সেস (সিবিটিবি)। ভারতের নাগরিকদের বিদেশে সম্পদ বা আয় আছে কি না, তা জানতে বিভিন্ন দেশে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের পক্ষ থেকেও গোয়েন্দা উদ্যোগ আছে। ওই সব দেশের দূতাবাসে প্রথম সচিবের মর্যাদায় একজন কর কর্মকর্তার নেতৃত্বে আছে ইনকাম ট্যাক্স ওভারসিজ ইউনিট (আইটিওইউ)।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারনাল রেভিনিউ সার্ভিস (আইআরএস) মার্কিন নাগরিকদের বিদেশে থাকা সম্পদ ঘোষণার সুযোগ দেয়। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ফরেন অ্যাকাউন্ট ট্যাক্স কমপ্লায়েন্ট অ্যাক্ট (এফএটিসিএ) নামে একটি আইন পাস করেছে। এর আওতায় বিশ্বের যেকোনো দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কোনো মার্কিন নাগরিকের যদি ৫০ হাজার ডলারের বেশি অর্থ বা সম্পদ থাকে, তা জানতে চাইতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। এই আইনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর গড়ে ৮০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ বাড়তি কর পেয়েছিল।