বাজেট হচ্ছে মূলত ব্যয় ব্যবস্থাপনা। যে অর্থ আছে তা কীভাবে ব্যয় করলে উন্নতি হবে, সেই পরিকল্পনার নামই আসলে বাজেট। বাজেট হচ্ছে একটি দেশের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব। এর লক্ষ্য পুরো রাষ্ট্রের কল্যাণ ও উন্নয়ন। সরকারকে দেশ চালাতে হয়, সরকারি কর্মচারী–কর্মকর্তাদের বেতন দিতে হয়, উন্নয়নের জন্য রাস্তাঘাটসহ নানা ধরনের অবকাঠামো তৈরি করতে হয়। আছে নাগরিকদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের জন্য ব্যয়। সুতরাং সরকারের ব্যয়ের খাত অনেক। সুতরাং একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরে সরকার কোথায় কত ব্যয় করবে, সেই পরিকল্পনার নামই বাজেট।
একজন মানুষকেও কিন্তু আয় ও ব্যয়ের হিসাব করতে হয়। তাঁর পরিবারের সবার জন্য পরিকল্পনা করতে হয়। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, যাতায়াত, চিকিৎসার জন্য অর্থ আয় ও ব্যয়ের ব্যবস্থা করতে হয়। এখানেও বাজেটের উদ্দেশ্য একই—ব্যক্তির নিজের ও পরিবারের কল্যাণ বা উন্নতি।
আসলে এক না। একটা কথা আমরা সবাই বলি। আর সেটি হলো আয় বুঝে ব্যয় করো। পার্থক্যটা আসলে এখানেই। আয় বুঝে ব্যয় করার ব্যাপারটা ব্যক্তি বা পরিবারের জন্য খুবই দরকারি। ব্যক্তি আগে আয় কত হবে, সেই হিসাব করেন, তারপর কোথায় কোথায় ব্যয় করতে হবে সেগুলো নির্ধারণ করেন। অন্যদিকে রাষ্ট্র করে ঠিক উল্টোটা। রাষ্ট্র আগে ব্যয়ের খাতগুলো নির্ধারণ করে। এরপর ঠিক করে, কোথা থেকে অর্থ আসবে। অর্থাৎ সরকার আয় করে খরচ বুঝে, আর ব্যক্তি ব্যয় করেন আয় বুঝে। আরেকটি বড় পার্থক্য তো আছেই। জাতীয় বাজেট হচ্ছে দেশের সব মানুষের উন্নতির জন্য, আর ব্যক্তি ভাবেন নিজের বা পরিবারের উন্নতির কথা।
রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে, দেশের নাগরিকদের জন্য কর্মসংস্থান বা আয়ের ব্যবস্থা করা। সেটি চাকরি হতে পারে, ব্যবসা হতে পারে, কৃষিকাজও হতে পারে। এখান থেকেই একজন ব্যক্তি আয়ের পথগুলো খুঁজে নেন। আর সে অনুযায়ীই ব্যয়ের পরিকল্পনা করেন।
রাষ্ট্রের আয়ের কতকগুলো উৎস আছে। মূলত রাষ্ট্র নাগরিকদের কাছ থেকে নানাভাবে কর আদায় করে। এগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন প্রত্যক্ষ কর, পরোক্ষ কর এবং করবহির্ভূত আয়। প্রত্যক্ষ করের মধ্যে আছে ব্যক্তিশ্রেণির আয়কর, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর কর (করপোরেট কর), দান কর, উত্তরাধিকার কর, যানবাহন কর, মাদক শুল্ক, ভূমি রাজস্ব ইত্যাদি। আর পরোক্ষ কর হচ্ছে আমদানি কর, আবগারি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), সম্পূরক শুল্ক—এই রকম নানা ধরনের কর।
কর ছাড়া আরও আয় আছে। যেমন বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের লাভ, সুদ, সাধারণ প্রশাসন থেকে আয়; ডাক, তার ও টেলিফোন থেকে আয়, পরিবহন আয়, জরিমানা ও দণ্ড থেকে আয়, ভাড়া, ইজারা, টোল ও লেভি থেকে আয় ইত্যাদি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সরকার পদ্মা সেতু বানিয়ে যোগাযোগব্যবস্থা সহজ করেছে, সহজে পণ্য বাজারে আনা যাচ্ছে; কিন্তু সাধারণ মানুষকে এই সেতু ব্যবহার করতে এখন টোল দিতে হচ্ছে—এটাই রাষ্ট্রের আয়।
আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হলে ব্যক্তি অর্থ ঋণ বা ধার হিসেবে নিতে পারেন। তবে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে। কেননা, তাকে ঋণ পরিশোধ করতে হয়। পরিশোধ করার ক্ষমতা নেই এমন ঋণ কোনো ব্যক্তি নিলে দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।
এই রাষ্ট্র আগে ব্যয়ের খাত নির্ধারণ করে, তারপর আয়ের উৎসগুলো খোঁজা শুরু করে। তাহলে কি আয় ও ব্যয় সমান হতে হবে? সমান হতে পারে, আবার না–ও হতে পারে। আয় ও ব্যয় সমান কি না, সেই প্রশ্নেও রাষ্ট্রের বাজেট দুই রকমের হয়। যেমন সুষম বাজেট এবং অসম বাজেট।
সরকারের মোট আয় ও মোট ব্যয় সমান হলে সেটি সুষম বাজেট। অর্থাৎ সরকারের মোট ব্যয় পরিকল্পনার সমানই হচ্ছে সম্ভাব্য আয়। আর অসম বাজেট হচ্ছে যেখানে আয় আর ব্যয় সমান হয় না। অসম বাজেট আবার দুই রকমের হতে পারে। যেমন উদ্বৃত্ত বাজেট ও ঘাটতি বাজেট। ব্যয়ের তুলনায় আয় বেশি হলে সেটি উদ্বৃত্ত বাজেট। ঘাটতি বাজেট হচ্ছে ঠিক উল্টোটা। এখানে ব্যয় বেশি, আয় কম।
ব্যয় বেশি হলে রাষ্ট্র কি করে পরিস্থিতি সামাল দেয়? রাষ্ট্রের বাজেট ও ব্যক্তির বাজেটের বড় পার্থক্য এখানেই। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হলে ব্যক্তি অর্থ ঋণ বা ধার হিসেবে নিতে পারেন। তবে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে। কেননা, তাকে ঋণ পরিশোধ করতে হয়। পরিশোধ করার ক্ষমতা নেই এমন ঋণ কোনো ব্যক্তি নিলে দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।
আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য না হলে দেশ-বিদেশ থেকে রাষ্ট্রও অর্থ ধার করতে পারে। রাষ্ট্রকেও সেই ঋণ পরিশোধ করতে হয়। পরিশোধ না করতে পারলে রাষ্ট্র যে দেউলিয়া হয় না তা নয়। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ শ্রীলঙ্কা। তবে রাষ্ট্রের সুবিধা হচ্ছে নেওয়া ঋণ বা ধার বছরের পর বছর টেনে নিয়ে যেতে পারে। রাষ্ট্র এই সুযোগ নিজেই তৈরি করে নেয়। এর ফলে দায় ক্রমাগত বাড়তে থাকে, তার উদাহরণ তো এ সময়ের বাংলাদেশই। সরকারের রাজস্ব ব্যয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাতই হচ্ছে সুদ পরিশোধ।
এ প্রসঙ্গে তাহলে দেখা যাক সরকার কোথায় কোথায় ব্যয় করে। সরকারের ব্যয় দুই রকম। একটি অনুন্নয়ন বা রাজস্ব ব্যয়। এটি হচ্ছে সরকার পরিচালনার খরচ। এই অনুন্নয়ন ব্যয় মোটা দাগে তিনটি। যেমন দেশরক্ষা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও প্রশাসন চালানোর খরচ। বাংলাদেশ একটি কল্যাণ রাষ্ট্র নয়। তারপরও বাজেটে একটি মানবিক চেহারা দেওয়ার চেষ্টা থাকে। এ জন্য নানা ধরনের সামাজিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। আবার কৃষি ও জ্বালানি খাতে সরকার ভর্তুকি দেয়। এরও ব্যয় আছে।
দেশ পরিচালনায় যত ধরনের ব্যয় আছে, তা পূরণ করে আয়ের বাকি অর্থ দিয়ে সরকার উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করে। এ জন্য বরাদ্দ রাখা অর্থই উন্নয়ন বাজেট। এই অর্থ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। রাস্তা নির্মাণ, সেতু নির্মাণ থেকে শুরু করে গ্রামীণ উন্নয়ন, বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল তৈরিসহ নানা ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করে সরকার। রাজস্ব উদ্বৃত্ত ও দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে নেওয়া ঋণ নিয়ে উন্নয়ন বাজেট করা হয়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) নামে একটি প্রকল্প খাত রয়েছে। এই খাতেই সাধারণত উন্নয়ন বাজেটের খরচ দেখানো হয়।
বাংলাদেশ সরকারের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। সুতরাং প্রথম দিন থেকেই বাংলাদেশ ঘাটতি বাজেট করে আসছে। ধার করে সরকার এই বাজেট–ঘাটতি পূরণ করে। যেমন বৈদেশিক উৎস এবং অভ্যন্তরীণ উৎস। বৈদেশিক উৎস মূলত বৈদেশিক ঋণ। সরকার বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশ থেকে সহজ শর্তে ঋণ নেয়। বৈদেশিক উৎস থেকে বেশি ঋণ নিয়ে ঘাটতি পূরণ করতে পারলে তা অর্থনীতির জন্য বেশি সহনীয়। কারণ, এতে সুদহার কম এবং পরিশোধে অনেক সময় পাওয়া যায়। যদিও এ জন্য নানা ধরনের শর্ত পূরণ করতে হয়। যেমন এখন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচির মধ্যে আছে। এ জন্য অনেক শর্তও পূরণ করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে সরকার দুই ভাবে দেশের ভেতর থেকে ঋণ নেয়। যেমন ব্যাংকিং–ব্যবস্থা ও ব্যাংকবহির্ভূত–ব্যবস্থা। ব্যাংকবহির্ভূত–ব্যবস্থা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। এভাবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ঋণ নেয় সরকার। তবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার দুটি বিপদ আছে। ব্যাংকিং–ব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের জন্য অর্থ থাকবে কম। ফলে বিনিয়োগ কমে যায়। আর ব্যাংকবহির্ভূত–ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিলে বেশি হারে সুদ দিতে হয়। এতে সুদ পরিশোধে সরকারকে বেশি পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ রাখতে হয়। এতে পরের অর্থবছরের বাজেট বেড়ে যায়।
ব্যক্তি যা পারেন না, সরকার কিন্তু তা করতে পারে। সরকার টাকা ছাপিয়ে বাজেট–ঘাটতি পূরণ করতে পারে। তবে এই পথে বাজেট–ঘাটতি পূরণ করার বিপদও আছে। এতে মুদ্রা–সরবরাহ বেড়ে যায় এবং মূল্যস্ফীতি তৈরি। এখন যে বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, এর অন্যতম কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক এক বছর আগে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দিয়েছে।
ঘাটতি বেশি থাকাটা আবার ভালো নয়। সাধারণত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ পর্যন্ত ঘাটতিকে মেনে নেওয়া হয়।
সাধারণত উন্নত দেশগুলো সুষম বাজেট করে থাকে। তবে প্রতিবছরই সুষম বাজেট করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। উন্নত বা ধনী দেশগুলো বাণিজ্য চক্র মেনে সুষম বাজেট করে। অর্থাৎ অর্থনীতির ওঠা–নামার সঙ্গে সমন্বয় করে একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরের বাজেট তৈরি করা হয়। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো হলে সুষম বাজেট, খারাপ হলে ঘাটতি বাজেট। অনেক উন্নত দেশই আইন করে সুষম বাজেট তৈরি করে।
অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, অব্যাহতভাবে সুষম বাজেট তৈরি করা ভালো কিছু নয়; বরং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই বাজেট কেমন হবে তা ঠিক করা উচিত। কেননা, সুষম বাজেট সুদের হার কমায়, বাড়ায় সঞ্চয় ও বিনিয়োগ। এ ছাড়া বাণিজ্যঘাটতি কমিয়ে আনে। এতে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতি এগিয়ে যায়।
সাধারণত অর্থনীতি ভালো অবস্থায় থাকলে সুষম বাজেট করা হয়, খারাপ হলে অর্থনীতিকে উদ্দীপনা দিতে তৈরি হয় ঘাটতি বাজেট। একটা সময় ছিল যখন ঘাটতি বাজেটকে ক্ষতিকর ও সরকারের দুর্বলতাও ভাবা হতো। পরিস্থিতি এখন পাল্টেছে; বরং অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে কিছুটা ঘাটতি থাকা ভালো। এতে অব্যবহৃত সম্পদের ব্যবহার বাড়ে, ঘাটতি পূরণের চাপ থাকে। তাতে অর্থনীতিতে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। ঘাটতি বেশি থাকাটা আবার ভালো নয়। সাধারণত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ পর্যন্ত ঘাটতিকে মেনে নেওয়া হয়।
যদিও ক্ল্যাসিক্যাল বা ধ্রুপদি অর্থশাস্ত্রীরা ঘাটতি বাজেট অনুমোদন করতেন না। তবে জাতীয় আয় বাড়াবার একটি কৌশল হিসেবে ঘাটতি বাজেটের মাধ্যমে সম্পদ সংস্থানের ব্যবস্থাকে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনসই প্রথম অনুমোদন করেন। তাঁর মতে অর্থব্যবস্থায় অপূর্ণ নিয়োগের সমস্যা দূর করতে হলে এবং মন্দাভাব এড়াতে হলে বাজেটে সমস্থিতি বজায় রাখলে কোনো কাজ হবে না। এর জন্য চাই ঘাটতি বাজেটের মাধ্যমে অতিরিক্ত ব্যয় বরাদ্দ করে নতুন আয় সৃষ্টি। এতে জাতীয় আয় বাড়ে এবং অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।