মহামারিজনিত সব বিধিনিষেধ প্রত্যাহার হওয়ার পর অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেল আবারও চাঙা হয়েছে। এতে ২০২২ সালে প্রবাসী আয় কমবে।
কয়েক মাস ধরেই দেশে প্রবাসী আয় কমছে। সামগ্রিকভাবে বছর শেষে দেশে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ কমবে, এমনটাই ধারণা করছিলেন অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে বিশ্লেষকেরা। এবার বিশ্বব্যাংকের মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্রিফ ৩৭-এ জানা গেল, চলতি ২০২২ সালে দেশে প্রায় ২১ বিলিয়ন বা ২ হাজার ১০০ কোটি ডলার সমপরিমাণ প্রবাসী আয় আসতে পারে, ২০২১ সালে যা ছিল ২২ বিলিয়ন বা ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার।
মহামারির মধ্যে ২০২০ সালে বাংলাদেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে ২২ বিলিয়ন বা ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার প্রবাসী আয় আসে। তখন যাতায়াত সমস্যার কারণে অপ্রাতিষ্ঠানিক পথে প্রবাসী আয় আসা কমে গিয়েছিল, সে জন্য আনুষ্ঠানিক পথে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এরপর আর প্রবাসী আয় বাড়েনি। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০২১ সালেও দেশে ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার প্রবাসী আয় আসে আর চলতি বছর তা আরও কমে যেতে পারে বলে বিশ্বব্যাংকের আশঙ্কা।
‘রেমিট্যান্সেস ব্রেভ গ্লোবাল হেডউইন্ডস বা প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়ছে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় আসা কমার পেছনে খোলাখুলিভাবে সমান্তরাল বা অপ্রাতিষ্ঠানিক বিনিময় হারের কথা বলা হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, সরকার প্রবাসী আয়ের জন্য ডলারের দর বেঁধে দিলেও অপ্রাতিষ্ঠানিক বাজারে প্রবাসীরা আরও বেশি দর পান।
এ ক্ষেত্রে ডলারপ্রতি ৩-৪ টাকার পার্থক্য থাকে। সে কারণে দেশে হুন্ডির মাধ্যমে প্রবাসী আয় আসা কেবল বাড়ছেই। আর মহামারিজনিত সব বিধিনিষেধ প্রত্যাহৃত হওয়ার পর অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেল আবারও চাঙা হয়েছে। সম্প্রতি অর্থনৈতিক রিপোর্টার্স ফোরামের এক অনুষ্ঠানে জানানো হয়, দেশে যত প্রবাসী আয় আসছে, তার ৪৯ শতাংশই আসে অবৈধ পথে।
বিশ্লেষকেরা বলেন, মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, হুন্ডির টাকা আনুষ্ঠানিক পথে নিয়ে আসা। সে জন্য ডলারের যৌক্তিক বিনিময় হার নির্ধারণ এবং দ্রুত ও প্রযুক্তিভিত্তিক অর্থ স্থানান্তর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার বলে তাদের মত।
এ বিষয়ে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সানেমের চেয়ারম্যান বজলুল হক খন্দকার বলেন, ‘প্রবাসী আয় বৃদ্ধি করতে টাকার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে উচিত। মানুষ কষ্টার্জিত অর্থ কোন মাধ্যমে পাঠাবেন, এটা তাঁর সিদ্ধান্ত। ফলে তাঁরা যে মাধ্যমে বেশি পাবেন, সেই মাধ্যমেই টাকা পাঠাবেন। আর আমার ধারণা, প্রবাসীরা হয়তো ধারণা করছেন, ডলারের বিনিময়মূল্য আরেকটু বাড়বে, সে কারণে তাঁরা এখন অত বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন না।’
প্রবাসী আয় পাওয়ার দিক থেকে সবার ওপরে আছে ভারত। ২০২২ সালে তাদের প্রবাসী আয়ের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার। প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ১২ শতাংশ। ৬০ বিলিয়ন বা ৬ হাজার কোটি ডলার নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকবে মেক্সিকো। তৃতীয় স্থানে থাকবে চীন—তারা পাবে ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।
গত দুই বছরে মহামারির কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রবাসী শ্রমিক যাওয়ার হার কমেছে। সেই সঙ্গে শ্রমিকদের নিম্ন দক্ষতার কারণেও আয়ের পরিমাণ বাড়ছে না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষত ডিজিটাল দক্ষতার কথা বলা হয়েছে, এই দক্ষতা না বাড়লে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় বাংলাদেশি শ্রমিকদের অভিবাসন হার বাড়বে না। এসব দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকেরা কারখানায় কাজ করেন। অটোমেশনের এই যুগে ডিজিটাল দক্ষতা ছাড়া কাজ করা কঠিন।
বিশ্বব্যাংক কারখানা মালিকদের ওপর যে জরিপে চালিয়েছে তাতে প্রায় ৭০ শতাংশ কারখানা মালিক বলেছেন, মৌলিক ও প্রায়োগিক ডিজিটাল দক্ষতা এখন কর্মক্ষেত্রের জরুরি প্রয়োজন হয়ে উঠেছে। কিন্তু বাংলাদেশি শ্রমিকদের এই দক্ষতা কম থাকায় পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে তাদের চাহিদা কম। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার নির্মাণ খাতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, সেখানে যে ডিজিটাল দক্ষতা প্রয়োজন হয় না। অথচ ভারতের প্রবাসী আয় বৃদ্ধির পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে ডিজিটাল দক্ষতা।
ডলারের বিনিময়মূল্য বৃদ্ধি, বিশ্বজুড়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি—এসব কারণে দেশের আমদানি ব্যয় বেড়েছে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে। এ পরিস্থিতিতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় দুই উৎস রপ্তানি ও প্রবাসী আয় সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর—টানা দুই মাস কমেছে, যদিও নভেম্বর মাসে তা আবার কিছুটা বেড়েছে। এই কমতির ধারা বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ নিয়ে দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
স্বস্তির জন্য প্রায় ছয় মাসের আমদানি ব্যয় নির্বাহের মতো রিজার্ভ থাকা দরকার বলে মত দেন বিশ্লেষকেরা। সে লক্ষ্যে প্রতি মাসে প্রায় ২৫০ কোটি ডলার প্রবাসী আয় দেশে আসা উচিত। করোনা–পরবর্তী সময়ে যেভাবে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাড়ছে, তাতে এটা কঠিন কিছু নয় বলেই বিশ্লেষকদের মত। শুধু সরকারকে সঠিক নীতি প্রণয়ন করতে হবে।