ডলার-সংকট

ভ্রমণ, শিক্ষা, চিকিৎসায় ডলার খরচ বেড়েছে ৩৩%

গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে বিদেশ ভ্রমণে খরচ হয়েছে ১ হাজার ২৩৪ কোটি ডলার। আগের বছর একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৯২৪ কোটি ডলার।

ডলার
ছবি: সংগৃহীত

ডলার–সংকটের এই সময়েও আমদানির বাইরে বৈধ পথে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ বেড়ে গেছে। করোনার ধাক্কা কাটার পর বিদেশে ঘোরাঘুরিও বেড়েছে, এতে বেড়েছে ভ্রমণ খরচ। আবার বিদেশে চিকিৎসা ও শিক্ষার পেছনেও খরচ বেড়েছে। ফলে এসব খাতে ডলার খরচ বেড়ে গেছে। আবার প্রযুক্তি ও তথ্যসেবা কিনতে বেশি খরচ করতে হচ্ছে এখন। ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরে এসব খাতে বাংলাদেশের যে ডলার খরচ হয়েছিল, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে তার চেয়ে ৩৩ শতাংশ বেশি ডলার খরচ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

তবে এই হিসাব শুধু কার্ড ও বৈধভাবে যাঁরা পাসপোর্ট এনডোর্স করে বিদেশে ডলার নিয়ে খরচ করছেন, সেই তথ্য অনুযায়ী। এর বাইরে বিদেশে যাওয়ার সময় পকেটে করে যে ডলার নিয়ে যাওয়া হয়, তার তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে বাংলাদেশিরা বিভিন্ন সেবার জন্য বিদেশে ৯২৪ কোটি ডলার খরচ করেছিলেন। ২০২১-২২ অর্থবছরে একই সময়ে এই খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ২৩৪ কোটি ডলারে। ফলে বিদায়ী অর্থবছরের ১১ মাসে বিদেশে ডলারে খরচ আগের বছরের চেয়ে ৩৩ দশমিক ৫১ শতাংশ বেড়েছে।

২০২১ সালের মধ্যভাগ থেকে বিশ্বের অনেক দেশের সীমান্ত খুলে দেওয়া হয়। ফলে মানুষের মধ্যে বিদেশ ভ্রমণের আগ্রহ বেড়ে যায়। আবার অনেকের আটকে থাকা প্রয়োজনীয় ভ্রমণও শুরু হয়। সব মিলিয়ে তাই বিদায়ী অর্থবছরে ডলারের ব্যবহার বেড়ে গেছে।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার কারণে অনেক দেশের ভিসা বন্ধ ছিল। এ কারণে শিক্ষার্থীরাও আটকে পড়েছিলেন। চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়াও সীমিত হয়ে পড়েছিল। ২০২১ সালের মধ্যভাগ থেকে বিশ্বের অনেক দেশের সীমান্ত খুলে দেওয়া হয়। ফলে মানুষের মধ্যে বিদেশ ভ্রমণের আগ্রহ বেড়ে যায়। আবার অনেকের আটকে থাকা প্রয়োজনীয় ভ্রমণও শুরু হয়। সব মিলিয়ে তাই বিদায়ী অর্থবছরে ডলারের ব্যবহার বেড়ে গেছে। এ কারণে ডলারের ওপর চাপও বেড়েছে।’

বাংলাদেশের নাগরিকেরা ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে বিদেশে ভ্রমণের পেছনে খরচ করেন ৩৮ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। বিদায়ী অর্থবছরের একই সময়ে যা বেড়ে হয় ৮৪ কোটি ৯৭ লাখ ডলার। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশের নাগরিকেরা এখন মালদ্বীপ, দুবাই, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, নেপাল, সিঙ্গাপুর, ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে নিয়মিত ঘুরতে যাচ্ছেন। অনেকের পরিবার দীর্ঘ সময় এসব ভ্রমণে থাকছেন। ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলের পাশাপাশি খোলাবাজারেও ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত কয়েক মাসে ডলারের দাম ৮৬ থেকে বেড়ে ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা হয়েছে। আর খোলাবাজারে ডলারের দাম ১১০ টাকায় উঠেছে।

কারওয়ান বাজারের ক্যামিয়ার ট্রাভেলসের পরিচালক ইশতিয়াক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর অনেক দেশ ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার পর বিমানের টিকিট বিক্রি বেড়েছে। অনেকেই এখন ঘুরতে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে যাওয়া-আসার টিকিট বিক্রি বেড়েছে।

‘বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসার জন্য বিদেশযাত্রা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই ভারতে যাচ্ছেন। থাইল্যান্ডে যাচ্ছেন ১৫ শতাংশ এবং অন্য দেশে যাচ্ছেন ৫ শতাংশ মানুষ।’
সাব্বির আহমেদ, মেডিএইডারের সহপ্রতিষ্ঠাতা

তবে যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তাঁদের সবাই যে ঘুরতে যাচ্ছেন, তা নয়। ২০২০-২১ অর্থবছরের ১১ মাসে বিদেশে চিকিৎসা বাবদ খরচ হয়েছে ১৭ লাখ ডলার। বিদায়ী অর্থবছরের একই সময়ে যা বেড়ে হয়েছে ২৯ লাখ ডলার।

বাংলাদেশিদের কাছে চিকিৎসার জন্য এখন জনপ্রিয় গন্তব্য ভারত। পাশাপাশি থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নত দেশেও চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন অনেকে। এ কারণে দেশে মেডিকেল ট্যুরিজম–সেবাও জনপ্রিয় হচ্ছে।

মেডিএইডারের সহপ্রতিষ্ঠাতা সাব্বির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসার জন্য বিদেশযাত্রা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই ভারতে যাচ্ছেন। থাইল্যান্ডে যাচ্ছেন ১৫ শতাংশ এবং অন্য দেশে যাচ্ছেন ৫ শতাংশ মানুষ।’

এদিকে বিদেশে পড়াশোনার পেছনে এ দেশের শিক্ষার্থীরা ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে খরচ করেছেন ২৪ কোটি ৩১ লাখ ডলার। বিদায়ী অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭ কোটি ৭২ লাখ ডলার। ফলে করোনার ধাক্কার পর বিদেশে শিক্ষা খরচ বেড়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ।

গত ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে প্রযুক্তি ও তথ্যসেবা কিনতে খরচ হয় ৯ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। বিদায়ী অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ কোটি ৪৭ লাখ ডলারে। এ ছাড়া অন্য ব্যবসায়িক সেবার জন্য গত অর্থবছরে ডলার খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৭৩ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে যা ছিল ৫৪ কোটি ১৩ লাখ ডলার।

আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশে চার মাস ধরে ডলারের সংকট চলছে। কারণ, আমদানি যে হারে বেড়েছে, রপ্তানি সে হারে বাড়েনি। আবার প্রবাসী আয়ও কমেছে। সংকট সামলাতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। আর আমদানি কমাতে বিভিন্ন পণ্যে ঋণ বন্ধসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

পাশাপাশি ডলারের ওপর চাপ কমাতে ব্যাংকগুলোর গাড়ি কেনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকের ডলার ধারণের সীমা (এনওপি) হ্রাস, রপ্তানিকারকের প্রত্যাবাসন কোটায় (ইআরকিউ) ধারণকৃত ডলারের ৫০ শতাংশ নগদায়ন, ইআরকিউ হিসাবে জমা রাখার সীমা কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা এবং অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ইউনিটে স্থানান্তরের সুযোগ দেওয়া হয়।