আগামী মাসে কর মেলা। যে ৫০ লাখ টিআইএনধারী রিটার্ন জমা দেন না, তাঁদের জন্য ‘সাধারণ ক্ষমা’ রয়েছে এবার।
কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) থাকলেও যাঁরা এত দিন বার্ষিক আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন জমা দেননি, তাঁদের জন্য এবার রয়েছে বড় সুযোগ। তাঁরা জরিমানা ছাড়াই রিটার্ন জমা দিতে পারবেন, যাকে বলা হচ্ছে সাধারণ ক্ষমা।
সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কঠোরও হয়েছে। রিটার্ন জমা না দিলে বিভিন্ন সেবা পাওয়া যাবে না। চলতি (২০২২–২৩) অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময়ে এই নতুন পরিবর্তন আনা হয়। সম্প্রতি প্রকাশিত পরিপত্রে বিষয়টি আরও পরিষ্কার করা হয়েছে। এটি আলোচনায় এসেছে রিটার্ন জমার সময় ঘনিয়ে আসায়।
সাধারণত প্রতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাস জরিমানা ছাড়া বার্ষিক আয়কর বিবরণী জমা দেওয়া যায়। ফলে আগামী মাস, অর্থাৎ নভেম্বরই জরিমানা ছাড়া আয়কর বিবরণী জমার শেষ সময়। এ মাসে কর মেলার আয়োজন করবে এনবিআর। তবে প্রথমবার রিটার্ন জমাদানকারীরা আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত বিনা জরিমানায় আয়কর রিটার্ন দিতে পারবেন।
বর্তমানে প্রায় ৭৯ লাখ টিআইএনধারী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চার লাখের মতো চলতি অর্থবছরে টিআইএন নিয়েছেন। বাকি ৭৫ লাখ টিআইএনধারী আগে থেকেই ছিলেন। মোট টিআইএনধারীর মাত্র ২৫ লাখের মতো বছর শেষে রিটার্ন জমা দেন। বাকি ৫০ লাখ রিটার্ন জমা দেন না। টিআইএন বন্ধ করার কোনো সুযোগ আয়কর আইনে নেই।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, রিটার্ন জমা না দিলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানাসহ বিলম্ব মাশুল এবং নির্ধারিত আয়ের বিপরীতে সুদ আরোপ করার বিধান আছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে রিটার্ন জমায় এখন পর্যন্ত তেমন একটা সাড়া নেই। গত সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত তিন লাখের মতো করদাতা তাঁদের গত অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের খবর জানিয়ে রিটার্ন দিয়েছেন। অবশ্য প্রতিবারই শেষ দুই মাসে সিংহভাগ করদাতা রিটার্ন দিতে বেশি উদ্যোগী হন।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাঁরা এত দিন রিটার্ন জমা দেননি, তাঁদের সুযোগটি দেওয়া অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। তাঁরা করজালে চলে আসবেন। এত দিন হয়তো জরিমানা কিংবা ভীতির কারণে তাঁরা রিটার্ন দেননি।’
এবার রিটার্ন জমার ক্ষেত্রে বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। করমুক্ত আয়সীমা আগের মতোই আছে। ন্যূনতম করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা। এর বেশি করযোগ্য আয় থাকলে অবশ্যই কর দিতে হবে। এ ছাড়া সর্বনিম্ন কর এলাকাভেদে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা।
তবে একটি পরিবর্তন এসেছে। এত দিন নিয়ম ছিল, টিআইএন থাকলেই রিটার্ন দিতে হবে। তবে তাতে রিটার্ন জমা নিশ্চিত করা যায়নি। এবার বলা হয়েছে, ৩৮ ধরনের সেবা পেতে হলে রিটার্ন জমার রসিদ দেখাতে হবে। এসব সেবা পেতে রিটার্ন জমা দিয়ে রসিদ সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। রসিদ যাচাই না করলে যেসব প্রতিষ্ঠান এই সেবা দেবে, তাদের ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হবে।
২০ লাখ টাকার বেশি ব্যাংকঋণ পাওয়া, পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কেনা, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার, অনলাইনে বেচাকেনার ব্যবসা, রাইড শেয়ারিং বা শরিকি যাত্রায় মোটরগাড়ি দেওয়া ইত্যাদি। এমনকি সন্তানকে ইংরেজি সংস্করণে (ইংলিশ ভার্সন) পড়াশোনা করালেও রিটার্ন জমা দিতে হবে। তাই ভবিষ্যতে এসব সেবা পেতে এবার রিটার্ন দিতেই হবে। এ ছাড়া গাড়ির মালিক, অভিজাত ক্লাবের সদস্য, কোম্পানি পরিচালক, বণিক সংগঠনের সদস্য, পৌর থেকে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত প্রার্থী হলেও রিটার্ন দিতে হবে।
এ বিষয়ে মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, রিটার্ন না দিলে সেবা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর এ পদ্ধতিটি বেশ কার্যকর হবে। তবে যাঁদের করযোগ্য আয় নেই, তাঁদের রিটার্ন জমায় বাধ্য কেন করা হবে?
এনবিআর আশা করছে, এবার রিটার্ন জমা বাড়বে। সংস্থাটির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এবারের বাজেটে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করায় রিটার্ন জমা ২০ শতাংশের মতো বাড়তে পারে। ৩০ থেকে ৩২ লাখ রিটার্ন জমা পড়তে পারে। ধীরে ধীরে টিআইএনধারীদের নিয়মিত রিটার্ন জমার আওতায় আনা হবে।
এ বছর রিটার্ন দেওয়ার সময় করদাতাদের গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত আয়ের কত অংশ বিনিয়োগ করেছেন, তা নতুন করে হিসাব করতে হবে। কারণ, এবার কর রেয়াত পাওয়ার বিনিয়োগ সুবিধা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বার্ষিক আয়ের ২০ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারবেন। আর ধনী-গরিব সবাই ১৫ শতাংশ কর রেয়াত পাবেন।
রিটার্ন জমার সময় বেশ কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হবে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বেতন খাতের আয়ের দলিল, সিকিউরিটিজের ওপর সুদ আয়ের সনদ, ভাড়ার চুক্তিপত্র, পৌরকরের রসিদ, বন্ধকি ঋণের সুদের সনদ, মূলধনি সম্পদের বিক্রয় কিংবা ক্রয়মূল্যের চুক্তিপত্র ও রসিদ, মূলধনি ব্যয়ের আনুষঙ্গিক প্রমাণপত্র, শেয়ারের লভ্যাংশ পাওয়ার প্রমাণপত্র (ডিভিডেন্ড ওয়ারেন্ট) এবং সুদের ওপর উৎসে কর কাটার সার্টিফিকেট।
কর রেয়াত নিতে চাইলে জীবনবিমার কিস্তির প্রিমিয়াম রসিদ, ভবিষ্য তহবিলে চাঁদার সনদ, ঋণ বা ডিবেঞ্চার, সঞ্চয়পত্র, স্টক বা শেয়ারে বিনিয়োগের প্রমাণপত্র, ডিপোজিট পেনশন স্কিমে চাঁদার সনদ, কল্যাণ তহবিলে চাঁদা ও গোষ্ঠী বিমার কিস্তির সনদ, জাকাত তহবিলে চাঁদার সনদ—এসব দেখাতে হবে।
মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, এ দেশে কিছু লোকের বিপুল বিত্তবৈভব হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে ন্যায্য কর পাওয়া যায় না। তাঁরা কর ফাঁকি দেন কিংবা কর এড়িয়ে যান। অথচ তাঁরা লুটপাট করে বিদেশে টাকা পাচার করছেন, দামি বাড়ি-গাড়ি কিনছেন। তিনি বলেন, এনবিআরের একার পক্ষে তাঁদের কাছ থেকে কর আদায় করা সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ।