চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝপথে এসে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। তাতে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খরচ আরেক দফা বেড়ে যেতে পারে সাধারণ মানুষের। যেমন মুঠোফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির ফলে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ বাড়বে। আবার পোশাক–আশাকের দামও বাড়তে পারে ভ্যাট বৃদ্ধির কারণে। বাড়তে পারে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার খরচও।
এ ছাড়া মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে মিষ্টি, ওষুধ, এলপি গ্যাস, ফলের রস, ড্রিংক, বিস্কুট, চশমার ফ্রেম, সিগারেটসহ নানা পণ্যের।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে এ–সংক্রান্ত দুটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। অধ্যাদেশ দুটি হলো মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ এবং দি এক্সাইজ অ্যান্ড সল্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫। এই দুটি অধ্যাদেশ জারির প্রেক্ষাপটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট বিভাগ গতকাল এ–সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করে। এর ফলে এই অধ্যাদেশের পরিবর্তনগুলো সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়ে গেছে।
এর আগে ১ জানুয়ারি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির এনবিআরের প্রস্তাব পাস করা হয়। এরপর আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়। জাতীয় সংসদ না থাকায় অধ্যাদেশ দিয়েই শুল্ক-কর বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশকে দেওয়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের শর্ত হিসেবে অর্থবছরের মাঝপথে এসে এক শর বেশি পণ্য ও সেবায় শুল্ক-কর বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের কর এমন এক সময় বাড়ানো হলো, যখন দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে শুধু নিম্ন আয় ও প্রান্তিক আয়ের মানুষ নয়; মধ্যবিত্তরাও হিমশিম খাচ্ছে। তাদের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এখন নতুন শুল্ক-কর আরোপের ফলে এই শ্রেণির মানুষের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে।
সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির ফলে মুঠোফোনে কথা বলার খরচ আগের চেয়ে বাড়বে। এ ছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচও বেড়ে যাবে। কারণ, মুঠোফোনের সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৩ শতাংশ করা হয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার গত জুনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় মুঠোফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করেছিল। এ কারণে মোবাইল অপারেটরগুলো তাদের সেবার দামও বাড়িয়েছে। যার মাশুল গুনতে হয় মুঠোফোনের গ্রাহকদের।
ব্র্যান্ডের দোকান বা বিপণিবিতান থেকে তৈরি পোশাক কিনতে গেলেও এখন আগের চেয়ে বেশি ভ্যাট দিতে হবে। পোশাকের আউটলেটের বিলের ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে এক লাফে দ্বিগুণ করা হয়েছে। আগে এ খাতে ভ্যাট হার ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। এখন তা ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে পোশাকের দাম বাড়বে বলে জানান পোশাক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি তাঁরা ব্যবসা কমে যাওয়ারও আশঙ্কা করছেন। ব্র্যান্ডের পোশাক বা ব্র্যান্ড ব্যতীত পোশাকের দোকান—উভয় ক্ষেত্রেই নতুন ভ্যাট হার প্রযোজ্য হবে।
এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, কোভিডের পর থেকে এমনিতেই পোশাকের ব্যবসা মন্দা। রোজার ঈদের আগে নতুন করে ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে ব্যবসা আরও শ্লথ হবে।
সব ধরনের রেস্তোরাঁর বিলের ওপর ভ্যাট এক লাফে ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এত দিন এই হার ছিল ৫ শতাংশ। তাতে ১ হাজার টাকা খাবারের বিলে খরচ বাড়বে ১০০ টাকা।
সারা দেশে সোয়া পাঁচ লাখ রেস্তোরাঁ রয়েছে। শহর এলাকায় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আধুনিক এবং বৈচিত্র্যময় খাবারের দোকান আছে। শহুরে মানুষের মধ্যে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার প্রচলন চালু রয়েছে। ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি পরিবার-পরিজন নিয়ে রেস্তোরাঁর খেতে গেলে আগের চেয়ে বেশি অর্থ খরচ হবে।
এ ছাড়া মিষ্টির দোকানের ভ্যাটও সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে মিষ্টির দামও বেড়ে পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ফেসিয়াল টিস্যু, পকেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, টয়লেট টিস্যু, কিচেন টিস্যুসহ বিভিন্ন ধরনের টিস্যুর ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে নতুন অধ্যাদেশে। আগে এই হার ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। ভ্যাট বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার ফলে টিস্যুর দাম বাড়তে পারে।
বিস্কুট, জুস, ড্রিংক, ফলের রস, ইলেকট্রোলাইট ড্রিংক, কেক (৩০০ টাকার বেশি দামের), আচার, টমেটো সস ও কেচাপ ইত্যাদি শিশুরা বেশি পছন্দ করে। এসব পণ্যভেদে ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হয়েছে।
এ ছাড়া এলপি গ্যাসের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। অন্যদিকে এলপি গ্যাসের স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে বিদ্যমান ২ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। ওষুধের ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট হার ২ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। পাশাপাশি যেকোনো ধরনের স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
এনবিআরের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, তালিকায় থাকা অর্ধশতাধিক পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। শুল্ক-কর বৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে আমদানি করা বাদাম, আম, কমলালেবু, আঙুর, আপেল ও নাশপাতি, ফলের রস, যেকোনো ধরনের তাজা ফল, রং, ডিটারজেন্ট।
এ ছাড়া স্থানীয় উৎস বা দেশের মধ্যে উৎপাদিত তামাকযুক্ত সিগারেট, রং, মদের বিল, পটেটো ফ্ল্যাকস, প্লাস্টিক ও মেটাল চশমার ফ্রেম, রিডিং গ্লাস, সান গ্লাস, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ও তাতে ব্যবহৃত তেল, বৈদ্যুতিক খুঁটি, সিআর কয়েল, জিআই তারে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে।
মূল্যস্তর পরিবর্তন ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে সব ধরনের সিগারেটের দাম বাড়বে। বিভিন্ন মূল্যস্তরের সিগারেটে সম্পূরক শুল্ক সাড়ে ৬৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ শতাংশ করা হয়েছে।
বর্তমানে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ৫০ লাখ টাকা থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত বার্ষিক লেনদেন হলে টার্নওভার কর দিতে হতো। এখন বার্ষিক লেনদেন ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা হলেই টার্নওভার বা লেনদেন কর দিতে হবে।
আবগারি শুল্ক বাড়ানোয় আকাশপথে ভ্রমণে খরচও বাড়বে। অভ্যন্তরীণ পথে বিমানযাত্রায় আবগারি শুল্ক ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হয়েছে। সার্কভুক্ত দেশ ভ্রমণে আবগারি শুল্ক ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা এবং সার্কভুক্ত দেশের বাইরে (এশিয়ার মধ্যে) ২ হাজার থেকে বাড়িয়ে আড়াই হাজার টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণে আবগারি শুল্ক ৩ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা করেছে এনবিআর। বিমান টিকিটের দামের সঙ্গে যাত্রীদের কাছ থেকে এই শুল্ক আদায় করা হয়।
সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আইএমএফের চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড় এবং বাড়তি ঋণ পেতে শর্ত হিসেবে শুল্ক-কর বাড়ানোর মতো অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সরকার যে খুশি মনে এটা করেছে, তা–ও নয়। সরকার মনে করেছে, আইএমএফের অর্থ পেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে এবং বিনিময় হারের চাপ কমবে। তাই সরকারকে এই পথে যেতে হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক শীর্ষ কর্মকর্তাও জানিয়েছেন, উন্নয়ন সংস্থার চাপে অর্থবছরের মাঝামাঝি এসে এনবিআরকে শুল্ক-কর বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সব ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর একক ভ্যাট হার (১৫ শতাংশ) করার চাপ আছে।