প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা তিন ঘণ্টার বেশি সময় বৈঠক করেছেন। সরকারপ্রধানের কাছে ব্যাংকঋণের সুদহার ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে নতুন করে সুদহার যাতে না বাড়ে, আমদানিতে নির্ধারিত দরে ডলার প্রাপ্তি নিশ্চিত করাসহ আগামী বাজেটে বাস্তবায়নের জন্যও বেশ কিছু দাবিদাওয়া তুলে ধরেন ব্যবসায়ী নেতারা।
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নেতৃত্বে ব্যবসায়ী নেতারা গতকাল শনিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন। এর আগে বিকেল ৪টার দিকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কার্যালয়ে ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে এক দফা আলোচনা করেন সালমান এফ রহমান।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক ব্যবসায়ী নেতা প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তাঁদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম ও সাবেক সভাপতি জসিম উদ্দিন, মেট্রো চেম্বারের সভাপতি কামরান টি রহমান, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ, তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি এস এম মান্নান ও সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান, বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসসি) পরিচালক রিচার্ড ডি রোজারিও, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসসি) চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, বেসিস সভাপতি রাসেল টি আহমেদ, আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান প্রমুখ। বৈঠকে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটুও উপস্থিত ছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ী নেতাদের কথাই বেশি শুনেছেন। নোট নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী অল্প কয়েকটি বিষয়ে কথা বলেছেন। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কর অবকাশ-সুবিধা অব্যাহত রাখার দাবির প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১০ বছর কর অবকাশ পেয়েও যদি কোনো খাত দাঁড়াতে না পারে, তাহলে ওই খাতের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই হবে। কর অবকাশ-সুবিধা অনন্তকাল রাখা যাবে না।
বৈঠকে আলোচনার বিষয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আজ রোববার যোগাযোগ করলে বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, ‘সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যবসায়ী নেতাদের আলোচনা হয়েছে। তিনি সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। আমরা বেশ কিছু দাবিদাওয়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেছি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যবসায়ী নেতা জানান, ব্যাংকঋণের সুদের হার ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসার খরচ বেড়ে যাচ্ছে-এমন উদ্বেগের কথা প্রধানমন্ত্রীকে জানান ব্যবসায়ী নেতারা। নতুন করে সুদের হার যাতে না বাড়ে, সেই অনুরোধ করেন তাঁরা। পাশাপাশি পণ্য আমদানির ঋণপত্র খুলতে আমদানিকারকেরা যাতে নির্ধারিত দরে ডলার পান, সেটি সেটি নিশ্চিত করার দাবিও করেন ব্যবসায়ী নেতারা।
ব্যাংকঋণের সুদহার ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা চলতি মাসে কিছুটা সরব হয়েছেন। ১৬ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলমের নেতৃত্বে ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধিদল বৈঠক করে। এতে তাঁরা অভিযোগ করে বলেন, ব্যাংকঋণের সুদহার ও হঠাৎ ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ব্যবসার ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে কোনো নীতিমালায় হঠাৎ পরিবর্তন না করে তাঁদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি নীতি নেওয়ার পরামর্শ দেন তাঁরা। পাশাপাশি ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ব্যবসায় যে লোকসান হয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদি ঋণে রূপান্তরের প্রস্তাব করেন ব্যবসায়ীরা।
বৈঠক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বিজিএমইএর সভাপতি এস এম মান্নান বেশ কিছু দাবিদাওয়া তুলে ধরেন। তিনি রপ্তানিতে উৎসে কর কমানোর অনুরোধ করেন। এ ছাড়া শিল্পাঞ্চলের বাইরের কারখানায় গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংযোগ এবং ব্যাংক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার পাশাপাশি বিকল্প নগদ সহায়তা না দেওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান প্রণোদনা বহাল রাখার দাবি করেন। একই সঙ্গে শ্রমিকদের রেশন দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতেও অনুরোধ করেন।
জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে শেয়ারবাজার পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসসি) পরিচালক রিচার্ড ডি রোজারিও এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসসি) চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম দীর্ঘ বক্তব্য দেন। আগামী অর্থবছরের বাজেটে মূলধনি মুনাফার ওপর কোনো কর আরোপ না করার দাবি জানিয়ে রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, শেয়ারবাজার এখন খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। এই পরিস্থিতিতে মূলধনি মুনাফার ওপর কর আরোপ করলে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
রিচার্ড ডি রোজারিও শেয়ারবাজারের নীতি প্রণয়নে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ইতিবাচক সম্মতি দিয়েছেন বলে বৈঠক সূত্রে জানা যায়।