অর্থনীতির সংকট উত্তরণে বড় দুই দলের নির্বাচনী ইশতেহারে কৌশল থাকা দরকার।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রার বিনিময় হার ও সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।
ব্যাংক খাতের দুর্বলতার কথা বারবার বলা সত্ত্বেও তা অস্বীকার করা হয়েছে।
রাজনীতি ঠিক না হলে অর্থনীতি ঠিক হবে না। অর্থনীতিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হলে প্রয়োজন জনগণের রায়ে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার। কারণ, সংস্কারের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক গুণগত পরিবর্তনের জন্য প্রথম প্রতিষ্ঠান হলো রাজনীতি। এটিই বাকি সবকিছুর গন্তব্য ঠিক করবে। তাই আগামী নির্বাচনে বড় দুটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে অর্থনীতিতে চলমান সংকটের উত্তরণকালীন কৌশল দরকার।
গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলো আয়োজিত ‘অর্থনীতিতে সংকট কেন, উত্তরণ কোন পথে’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সাবেক ব্যাংকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অংশ নেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন।
বৈঠকে অর্থনীতির চলমান সংকটের কারণ, প্রয়োজনীয় সংস্কার, রাজনীতি, কৌশল—এসব বিষয় উঠে আসে। বক্তারা বলেন, অর্থনীতির বর্তমান সংকট এক দিনে তৈরি হয়নি। এটি এখন আর নির্দিষ্ট খাতেও সীমাবদ্ধ নেই। সব খাতে এ সংকট ছড়িয়ে পড়েছে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে অর্থনীতির আকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজস্ব আদায় বাড়েনি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশ এমন একটি ক্রান্তিকালে অবস্থান করছে, যেখানে উন্নয়নের উত্তরণ গণতান্ত্রিক উত্তরণের সঙ্গে প্যাঁচ খেয়ে গেছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘একদিকে জবাবদিহি ও প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি চাইব—যেখানে অপচয় হবে না, অতিমূল্যায়িত প্রকল্প বানাব না, বৈষম্য সৃষ্টি করবে না, বিভাজন করবে না। আর রাজনীতির ভেতরে থাকবে—ভোট দিতে পারব না, দলের ভেতরে গণতন্ত্র থাকবে না, স্থানীয় সরকার ঠিকমতো কাজ করবে না। আর গণতান্ত্রিক উত্তরণও হবে না। প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি ছাড়া প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি অর্জন সম্ভব নয়।’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, প্রাতিষ্ঠানিক গুণগত পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি হলো প্রথম প্রতিষ্ঠান। রাজনীতিই বাকি সবকিছুর গন্তব্য ঠিক করবে। সংকট উত্তরণে বড় দুই দলের কাছে নির্বাচনী ইশতেহারে উত্তরণকালীন কৌশল দরকার।
অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর জোর দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী। তিনি বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে। আশা করি, আগামী নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু হবে। এর ফলে অর্থনৈতিক সংস্কারে শক্তি পাওয়া যাবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের মতে, আগামী নির্বাচনের কয়েক মাস বাকি। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষে অর্থনীতিতে বড় ধরনের মৌলিক কোনো পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাই সরকারকে এখন নির্বাচনপূর্ব তিন মাসের জন্য স্বল্প মেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘নির্বাচন–পরবর্তী অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ না নেওয়া হলে যে সরকারই আসুক, তারা পুরো মেয়াদ পূর্ণ করতে পারবে না। কারণ, অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিকে পাঁচ বছর মেয়াদে টেনে নেওয়া সম্ভব না। তিনি বলেন, একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ঠিক না থাকলে কোনো রাজনৈতিক সরকারই টিকতে পারে না। সেটা আমরা শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানসহ অনেক দেশে দেখেছি।’
আহসান এইচ মনসুরের মতে, নির্বাচনের আগে সরকারকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি জোর দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন বা দেড় হাজার কোটি ডলারের নিচে নামতে দেওয়া যাবে না।
নির্বাচনের আগে আগামী তিন মাসে নতুন বিনিয়োগ তেমন হবে বলে মনে করেন না মুস্তফা কে মুজেরী। তিনি বলেন, ব্যাংক খাতের সংস্কারও এর মধ্যে সম্ভব হবে না। তাই তিন মাসের জন্য একটা স্বল্প মেয়াদি কর্মসূচি ঠিক করা উচিত। তিনি বলেন, আপাতত তিনটি সমস্যা মোকাবিলা করা এখন জরুরি। এগুলো হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ডলারের বিনিময় হার ঠিক করা এবং রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নয়ন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বলেন, মূল্যস্ফীতি ও বৈষম্য এখন নিম্ন আয়ের মানুষের মূল সমস্যা। বৈষম্যের কথা তাঁরা সরাসরি না বললেও বিষয়টি তাঁদের ধারণার মধ্যে আছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আর্থিক ও রাজস্বনীতি ব্যবহার করা যায়; এর বাইরে আছে মূল্যস্ফীতির কিছু অদৃশ্য কারণ, যেমন চাঁদাবাজি। পথে পথে চাঁদা দিতে হয় বলে ছোট ব্যবসায়ীরা শেষমেশ সেই দায়ভার ক্রেতার ওপর চাপিয়ে দেন। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রার বিনিময় হার ও সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।
মুস্তফা কে মুজেরীর মতে, মূল্যস্ফীতি বেশি হওয়ার জন্য প্রথমে বলা হয়েছে কোভিড-১৯ দায়ী। পরে দায় চাপানো হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর। বলা হয়েছে, এ সমস্যা বাইরে থেকে আসা এবং আমদানি ব্যয় ও পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব বলতে বলতে মূল্যস্ফীতি এখন এত বেড়ে গেছে যে বিশ্ব পরিস্থিতি ভালো হলেও দেশে তা ভালো হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। অথচ ভারত, শ্রীলঙ্কা এমনকি পাকিস্তানও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে এসেছে। তাঁর মতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে একটাই অস্ত্র আছে। সেটা হচ্ছে ব্যাংকের সুদের হার বাড়ানো। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি প্রথম দিকে সুদের হার বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিত, তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভালো ভূমিকা রাখতে পারত।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থনীতির আকার গত দুই দশকে যত বড় হয়েছে, তার সঙ্গে মিলিয়ে আর্থিক খাত যত বড় হওয়ার কথা ছিল, সেটি হয়নি। বরং আরও সংকুচিত হয়ে গেছে। বন্ড বাজারের কোনো উন্নয়ন হয়নি। শেয়ারবাজার এমনিতেই দুর্বল ছিল—এখন ফ্লোর প্রাইস দিয়ে সেটাকে বসিয়ে দিয়েছি। এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগে স্থবিরতা, কর্মসংস্থানে অস্থিরতা বিরাজ করছে। নতুন চাকরি কম।
মুস্তফা কে মুজেরীর মতে, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর দুর্বলতার কথা নানা জায়গা থেকে বারবার বলা সত্ত্বেও তা অস্বীকার করা হয়েছে। এ খাতের দুর্বলতা দূর করার পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক যে এ খাতের দুর্বলতার ছয়টি কারণ চিহ্নিত করেছে, তার একটা হচ্ছে করপোরেট সুশাসনের অভাব। আগে তো সরকারি ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্য খারাপ ছিল, এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্যও ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে শুরু করেছে।
ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জয়তুন বিজনেস সলিউশনের চেয়ারম্যান আরফান আলী বলেন, ব্যাংক খাতে সুশাসনের চর্চার যে অভাব, তা দীর্ঘদিনের। ব্যাংকের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয় পরিচালনা পর্ষদ, আর তা বাস্তবায়ন করতে হয় ব্যাংকারদের। এ ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হলে সে দায় গিয়ে পড়ে ব্যাংকারদের ওপর। একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার ঋণখেলাপিদের সুযোগ দিয়ে ঋণ পুনঃ তফসিল করার নীতিমালা দিচ্ছে আর তা ব্যাংককে বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে। এই দায়ও গিয়ে পড়ছে ব্যাংকারদের ওপর। তাঁর মতে, দেশের আইনপ্রণেতাদের ৭০ শতাংশই ব্যবসায়ী। তাই আর্থিক খাতে খুব বেশি সুশাসন আশা করা যায় না।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, ‘বেসরকারি খাতে আমরা একধরনের গোষ্ঠী শাসনতন্ত্রের প্রবণতা দেখছি। অর্থের জোগান, সহজে অর্থায়নের সুযোগসহ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। আবার শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো ব্যবসায়িক গ্রুপের ঋণ পুনঃ তফসিল করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’
শামস মাহমুদ আরও বলেন, ডলার–সংকটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিত্যপ্রয়োজনীয় নয় এমন পণ্য আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়। তাঁর মতে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যেভাবে কর আদায়ের পরিকল্পনা করছে, তা বেসরকারি খাতের বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কেন্দ্র করে বিপর্যয়কর কিছু ঘটলে দেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়ে যাবে। তখন তা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে।