মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ার ছয় লক্ষণ

অর্থনীতিতে ছয়টি লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, যেগুলো বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে ফেলে দিয়েছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি এমনটাই মনে করে। তাদের বিবেবচনায় লক্ষণগুলো হচ্ছে শিল্প খাতে কর্মসংস্থান ও উৎপাদনের বিপরীতমুখী সম্পর্ক; শিল্প খাতে উৎপাদন স্থবিরতা কিংবা হ্রাস; মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) রপ্তানি খাতের অপর্যাপ্ত অবদান; বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা; শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগের অপ্রতুলতা এবং সুশাসনের অভাব। গত দশকের মাঝামাঝি পর্যায় থেকেই বাংলাদেশ এই ফাঁদে পড়তে শুরু করে।

শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৫০ বছরে ১০০টি দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে মাথাপিছু আয় ৮ হাজার ডলার স্পর্শ করেই তারা মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ে গেছে; কিন্তু বাংলাদেশ এখনো সেই পর্যায়ের মাথাপিছু আয়ের কাছাকাছি নেই।

এ নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত এক-দেড় দশকে জাতীয় অগ্রযাত্রাকে এক জায়গায় থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। দৌড়ানোর পরিবর্তে আমরা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছি। কারণ, সর্বাঙ্গে ব্যথা। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলাটাকে মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ে যাওয়া বলা হচ্ছে। অন্যদিকে মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো দৌড়াচ্ছে।’

এই ছয় লক্ষণ হলো শিল্প খাতে কর্মসংস্থান ও উৎপাদনের বিপরীতমুখী সম্পর্ক; শিল্প খাতে উৎপাদন স্থবিরতা বা হ্রাস; মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) রপ্তানি খাতের অপর্যাপ্ত অবদান; বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা; শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগের অপ্রতুলতা; সুশাসনের অভাব।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘নব্বইয়ের দশকে বিভিন্ন খাতে যেসব সংস্কার হয়েছে, তার অনেক সুফল পেয়েছি অর্থনীতি ও সামাজিক খাতে; কিন্তু পরে সেই সংস্কারের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারিনি; বরং উল্টো কাজ করেছি। নতুন সংস্কারও তেমন একটা হয়নি। ব্যাংক খাতে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে (কেস টু কেস) নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) অকার্যকর করা হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। এসব কারণেই আমরা খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে চলছি।’

অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশ্বের দেশগুলোকে নিম্ন আয়, মধ্যম আয় ও উচ্চ আয়ের দেশ—এই তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছে বিশ্বব্যাংক। আবার মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে নিম্ন মধ্যম আয় ও উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে ভাগ করা হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, বর্তমানে কোনো দেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ১৪৫ মার্কিন ডলারের কম হলে সেটি নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এ ছাড়া মাথাপিছু আয় ১ হাজার ১৪৬ থেকে ৪ হাজার ৫১৫ ডলার হলে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ এবং ৪ হাজার ৫১৬ থেকে ১৪ হাজার ৫ ডলার হলে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গণ্য হয়। আর ১৫ হাজার ৫ ডলারের বেশি মাথাপিছু আয় হলে উচ্চ আয়ের দেশ চিহ্নিত হয়। বহু দেশ বহু বছর ধরে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পড়ে আছে। এ জন্য সেগুলো মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়েছে বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৬৭৫ মার্কিন ডলার।

২০২৬ সালে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের সময় ঠিক করা হয়েছে। মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার।

শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানই বলছে, দেশের প্রবৃদ্ধি অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না। রাষ্ট্রের সক্ষমতার অভাবে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশির মাথাপিছু আয় বাড়ছে না। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সব নৌকাকে এক স্রোতে আনতে পারছে না। সে জন্য শ্বেতপত্রে বিনিয়োগ স্থবিরতার কথা তুলে ধরে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোর সুপারিশ করা হয়েছে।

গত এক-দেড় দশকে জাতীয় অগ্রযাত্রাকে এক জায়গায় থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। দৌড়ানোর পরিবর্তে আমরা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছি। ...খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলাটাকে মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ে যাওয়া বলা হচ্ছে। অন্যদিকে মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো দৌড়াচ্ছে।
জাহিদ হোসেন, সদস্য, শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ।

প্রতিবেদনমতে, পরিসংখ্যানে কারসাজি দেখিয়ে গত দশকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ হলো দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী একটি দেশ; কিন্তু কৃষি ও অনানুষ্ঠানিক খাতে নিম্ন উৎপাদনশীলতা; সম্পদ বণ্টনে বিশৃঙ্খলা এবং প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি তৈরি করতে না পারার দুর্বলতা—এসব কারণে সুষম প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। এ ছাড়া উন্নয়নের মোহাচ্ছন্নতা তৈরির জন্য প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান বাড়িয়ে দেখাতে ক্ষমতাসীনেরা হস্তক্ষেপ করেছেন। এই প্রবৃদ্ধিকে ‘অলীক’ বলে মন্তব্য করেছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।

শ্বেতপত্রে আরও বলা হয়েছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার তৃতীয় পক্ষের স্বাধীন পর্যালোচনা ছাড়াই প্রকাশ করা হয়েছে। সরকারিভাবে সংগৃহীত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতেই কেবল তা করা হয়। কেবল সরকারি পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে দেখা গেছে, দুঃসময় বা দুর্যোগের সময়ও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ছিল অত্যন্ত চাঙা।

সাধারণত পরিসংখ্যান কারসাজির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি বাড়লে তাতে মাথাপিছু আয়ও বাড়ে; কিন্তু প্রকৃত অর্থে মাথাপিছু আয় ততটা হয়নি।

শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের প্রতিবেদনটি গত রোববার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তুলে দেয়। এই কমিটির প্রধান হলেন বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।