মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে এক দশক ধরে খেলা করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, একটা সূচক নিয়ে খেলা করলে তা কারও (অন্য সূচক) পক্ষে যায়, কারও বিপক্ষে।
এ কারণে অন্য সূচকও আঘাতপ্রাপ্ত হয়। যেমন আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে কর-জিডিপির হার। এটি আর বাড়তেই পারছে না। দেবপ্রিয় বলেন, প্রবৃদ্ধির হার ভালো থাকলে বিনিয়োগ ও রাজস্ব আয় যেমন ভালো থাকে, কর্মসংস্থানও ভালো হয়। কিন্তু প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে এসব সূচকের মিল পাওয়া যাচ্ছে না।
রাজধানীর নয়াপল্টনে গতকাল মঙ্গলবার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত মোয়াজ্জেম হোসেন স্মারক বক্তৃতায় দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা বলেন। ইআরএফ কার্যালয়ে আয়োজিত ‘সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও এগিয়ে যাওয়ার উপায়’ শীর্ষক এ স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে একক বক্তা ছিলেন দেবপ্রিয়। ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ইংরেজি দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস–এর সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ বক্তব্য দেন। সঞ্চালক ছিলেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম। ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস–এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রয়াত মোয়াজ্জেম হোসেনের সম্মানে এ স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করেছে ইআরএফ।
বক্তব্যের শুরুতেই দেবপ্রিয় ইআরএফের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এ এইচ এম মোয়াজ্জেম হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, দেশের প্রায় সব ইংরেজি দৈনিকে কাজ করেছেন মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি ইংরেজি সাংবাদিকতার স্তম্ভ এবং অর্থনৈতিক সাংবাদিকতার স্থপতি। ষাটের দশকের পর স্বাধীনতা এসেছিল। এরপর আসে নব্বইয়ের দশক, যা প্রতিশ্রুতিশীল ও গণতন্ত্রের অনন্য দশক হিসেবে পরিচিত। অথচ ধীরে ধীরে বাংলাদেশ এমন অবস্থায় এসেছে, যার সর্বশেষ উদাহরণ বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে বাধা। বাংলাদেশ ব্যাংকের দিক থেকে এখন এমন বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে তথ্য বের হলে নাশকতা হয়ে যেতে পারে। আর এ নাশকতাকারীরা হলেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাংবাদিকেরা!
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সুতা কাটা ঘুড়ির সঙ্গে তুলনা করে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে চার ধরনের ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন দেবপ্রিয়। এ ঘাটতির কারণেই জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় বাড়ছে না।
বাড়ছে না স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ। প্রবৃদ্ধি অনেকটা এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট বোয়িং চলার মতো। আর অতিমূল্যায়িত প্রকল্পগুলো হয়ে গেছে গলার কাঁটার মতো। ২ বা ৩ শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে প্রবাসী আয় বাড়ানো যাবে না। প্রবাসী আয়ের অর্থে দেশের এক বড় শিল্পগোষ্ঠী বিদেশ থেকে শিল্পের কাঁচামাল এনেছে, আর দেশ থেকে টাকা দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কথায় সরকার এখন বছরে চারবার প্রবৃদ্ধির হিসাব দেওয়ায় অনেক সত্যই উঠে আসছে।
ডাল মে কুচ কালা হ্যায়
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এত দিন গর্ব করা হতো—বিদেশি ঋণ নিয়ে কখনো খেলাপি হয়নি বাংলাদেশ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তেল আমদানির অর্থ পরিশোধ করা যাচ্ছে না। বিদেশিরা নিতে পারছে না মুনাফা। এয়ারলাইনস ব্যবসায়ীরা অর্থ পাচ্ছে না। তার মানে গর্বের জায়গায় ফাটল ধরে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যের ভিত্তিতে কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, এ কথা উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অনেকটা ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’। এ আলো তারা সহ্য করতে পারছে না। কারণও আছে। আলো শুধু আলোই দেয় না, তাপও দেয়। তার মানে সেখানে ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’। এখন এটা কি মসুর ডাল, না মুগ ডাল, নাকি সব জায়গাতেই ডাল—সেটাই এখন বোঝার বিষয়।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আগে তথ্য-উপাত্তের নৈরাজ্য ছিল, এখন হয়েছে অপঘাত। তথ্যের অপঘাতে বাংলাদেশ ব্যাংকেরই সুনামহানি হচ্ছে। তথ্য-উপাত্তের বড় উৎস বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যের আগে রপ্তানি-আমদানিসহ আর্থিক সূচকের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম আমরা। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তথ্য কেউ পাচ্ছেন, কেউ পাচ্ছেন না। ব্যবসায়ীরা তথ্য পাচ্ছেন, পাচ্ছেন না সাংবাদিকেরা।’
নীতি-নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে গেছে
দেশের নীতি-নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে গেছে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রশ্ন রাখেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশনা দেওয়ার পরও একটি ব্যাংকের মালিকানা কীভাবে বদল হয়ে যায়? তিনি বলেন, এমনকি নীতি ব্যাখ্যা করার জন্যও কাউকে পাওয়া যায় না। এ ছাড়া আছে নীতি সমন্বয়ের অভাব ও সমন্বয়হীনতা মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শক্তির দুর্বলতা। পাশাপাশি মুদ্রানীতি ও আর্থিক নীতি সমন্বয়ের ক্ষেত্রেও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা রয়েছে। এগুলো দূর করতে হবে এবং মুদ্রা বিনিময় হার ও সুদহারে আনতে হবে নমনীয়তা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য নিয়ন্ত্রণের সমালোচনা করে দেবপ্রিয় বলেন, এ ধরনের কাজ তখনই হয়, যখন বহুবাদ বা গণতন্ত্র উঠে যায়। উর্দি পরা ও উর্দিবিহীন আমলারা এগুলো করেন। কারণ, তাঁরা মানুষের সামনে জবাবদিহি করতে ভয় পান। সরকারের কোথায় কী ব্যয় হচ্ছে, এসব তথ্য তাঁদের কাছে থাকে, তবে সংসদ সদস্যরাও তা জানতে পারেন না।
দেবপ্রিয় বলেন, ‘সামনে বাজেট আসছে এবং বড় শিরোনাম হবে সর্বকালের সেরা আয়তনের বাজেট।
আসলে বাজেট বাস্তবায়ন হয় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। আর্থিক পরাবাস্তবতার মধ্যে আছি আমরা। সম্প্রতি এক জরিপে দুই-তৃতীয়াংশই বলেছেন, বাজেট থেকে কোনো প্রত্যাশা নেই তাঁদের। আসলে প্রত্যাশা থাকলেও অবিশ্বাস আছে। আর সরকারের অদক্ষতার বড় শিকার হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআরের সামনে প্রতিবছর অলৌকিক লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এদিকে কর দেওয়ায় মানুষ আগ্রহ পান তখনই, যখন করের অর্থ ঠিকভাবে ব্যয় হয়।’
খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে যাঁদের সুবিধা দিচ্ছে, তাঁদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। তবে সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে তিনি আশাবাদী। তাঁর মতে, অনেক সমস্যার মধ্যেও অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।