হঠাৎ করেই কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নেওয়া বেড়ে গেছে। গত আড়াই মাসে প্রায় ২১ লাখ টিআইএন নিয়েছেন করদাতারা। অর্থাৎ এ সময়ে প্রতিদিন গড়ে ২৮ হাজারের মতো টিআইএন নেওয়া হয়েছে। মূলত ৪৩ সেবায় টিআইএন গ্রহণ ও রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতার কারণে কয়েক মাস ধরেই টিআইএন নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সোমবার পর্যন্ত সারা দেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২০ লাখ ৮৯ হাজার ৭৫। আড়াই মাস আগেই গত ৮ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো টিআইএনধারীর সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়েছে। ওই দিন শেষে টিআইএনধারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ কোটি ৩ হাজার ৮৪৪।
ওই সময়ের পর টিআইএন নেওয়ার গতি আরও বেড়ে গেছে। এনবিআরের হিসাবে দেখা গেছে, গত দুই মাস প্রতিদিন গড়ে ২৮ হাজার ১৭৮ জন টিআইএন নিয়েছেন। গত নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি মাসেও দৈনিক ১০-১২ হাজার টিআইএন ইস্যু হতো বলে এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান।
কর্মকর্তারা জানান, রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র (পিএসআর) ছাড়া এখন অনেক সরকারি-বেসরকারি সেবা পাওয়া যায় না। তাই করযোগ্য আয় না থাকা সত্ত্বেও এখন অনেককে বাধ্য হয়ে টিআইএন নিতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন্য ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, টিআইএনের সংখ্যা বৃদ্ধি ইতিবাচক। এতে করের আওতা বাড়ছে। তবে জনসংখ্যা ও অর্থনীতি সম্প্রসারণের তুলনায় এই সংখ্যা এখনো কম। কর দিতে পারেন, এমন যোগ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে কর নেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। করের ভার যেন ধনীদের ওপর বেশি পড়ে, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, এ অর্থবছরে ৩৫ লাখ ৪০ হাজার ৪০৬ জন করদাতা রিটার্ন দিয়েছেন, যা আগের বছরের তুলনায় পাঁচ লাখের কিছুটা বেশি। এ বছর রিটার্ন বাবদ কর পাওয়া গেছে ৫ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা।
গত রোববার আয়কর বিভাগের সঙ্গে রাজস্বসংক্রান্ত বৈঠক করেন এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। বৈঠকে এনবিআর সদস্য, বিভিন্ন কর কমিশনাররা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে বেশ কয়েকজন কমিশনার জানান, ৪৩ ধরনের সরকারি–বেসরকারি সেবা গ্রহণে রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করার ফল মিলছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ টিআইএন নিচ্ছেন। এটি ভালো উদ্যোগ। নতুন যাঁরা টিআইএন নিয়েছেন, তাঁরা রিটার্ন দিলে কর বাড়বে এবং এর পাশাপাশি রিটার্ন জমাকারীর সংখ্যাও বাড়বে। তবে টিআইএন নেওয়া, রিটার্ন জমাসহ কর দেওয়ার অনলাইন ব্যবস্থাটি আরও সহজ করার তাগিদ দেন তাঁরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুযায়ী দেশে ৮৪ লাখ ৬০ হাজার ৩৮৪ জন টিআইএনধারী আছেন। এর আগের ছয় বছরে সাড়ে ৬৪ লাখ মানুষ টিআইএন নিয়েছিলেন। তখন প্রতিবছর গড়ে ১১ লাখের মতো করদাতা টিআইএন নিয়েছেন।
৪৩ সেবার তালিকা
চলতি অর্থবছরের আগে ৩৮ ধরনের সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। তবে চলতি অর্থবছরে এর আওতা আরও বাড়িয়ে ৪৩টি সেবা করা হয়।
এই ৪৩টি সেবার মধ্যে অন্যতম হলো ২০ লাখ টাকার বেশি ঋণ আবেদন করলে; পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনলে; ক্রেডিট কার্ড নিলে; কোনো কোম্পানির পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার হলে; ব্যবসায় সমিতির সদস্য হলে; কারও সন্তান বা পোষ্য ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করলে; অস্ত্রের লাইসেন্স নিলে; উপজেলা, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হলে; চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ হিসেবে কাজ করলে; ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ ও নবায়ন করলে; সিটি করপোরেশন এলাকায় গ্যাস-বিদ্যুৎসহ সরকারি পরিষেবার সংযোগ নিতে হলে; ১০ লাখ টাকার বেশি মেয়াদি আমানত থাকলে; সরকার কর্মচারী ১৬ হাজার টাকার বেশি মূল বেতন পেলে; নির্দিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক সিটি করপোরেশন এলাকায় বাড়িভাড়া বা লিজ গ্রহণের সময় বাড়ির মালিকের; নির্দিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক সেবা বা পণ্য গ্রহণকালে ওই পণ্য বা সেবা সরবরাহকারীর; ট্রাস্ট, তহবিল, ফাউন্ডেশন, এনজিও, ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী সংস্থা, সোসাইটি ও সমবায় সমিতির ব্যাংক হিসাব খুলতে ও চালু রাখতে; স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি ও কার্টিজ পেপারে ভেন্ডার বা দলিল লেখক হিসেবে নিবন্ধন, লাইসেন্স বা তালিকাভুক্তি করতে বা বহাল রাখতে; রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে এমন গঠিত কর্তৃপক্ষ বা অন্য সিটি করপোরেশন, পৌরসভায় অনুমোদনের জন্য ভবন নকশার আবেদন দাখিলকালে।