পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা আনতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সংস্কার প্রয়োজন। এ ধরনের সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। বিগত সরকারের আমলে তথ্য–উপাত্ত কারসাজির অভিযোগ আছে। নিজস্ব রাজনৈতিক বয়ান রচনায় পরিসংখ্যানকে নিজেদের মতো ব্যবহার করা হয়েছে গত সরকারের আমলে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ‘জনবান্ধব নীতি প্রণয়নে সঠিক উপাত্ত সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনায় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। প্রথম আলো ও ইউএনডিপি বাংলাদেশ যৌথভাবে এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। কারওয়ান বাজারের প্রথম আলো কার্যালয়ে এই বৈঠক হয়। এ আয়োজনে গবেষণা সহায়তা দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অন বাজেট অ্যান্ড পলিসি (সিবিপি)।
এদিকে অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কর্মকর্তারা জানান, গত এক বছরে তথ্য–উপাত্ত কারসাজিতে নীতিনির্ধারকদের চাপ ছিল না। বিবিএসের কর্মকর্তারাও চান বিবিএসের সংস্কার প্রয়োজন।
পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নেই
অনুষ্ঠানে দেশের পরিসংখ্যান ব্যবস্থাপনার সার্বিক চিত্র তুলে ধরেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, আগের সরকারের আমলে তথ্য–উপাত্তের বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল না। এসব তথ্য–উপাত্তের ভিত্তি করে বিগত সরকার উন্নয়নের বয়ান সৃষ্টি করেছিল।
কেন সন্দেহ সৃষ্টি হলো, তা নিয়ে সেলিম রায়হান বলেন, ‘তখন মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির তথ্য যখন দেওয়া হলো, তখনকার অর্থনীতির চলকগুলোর সঙ্গে মেলে না। বড় অভিযোগ হলো অতীতে মন্ত্রীরা বলে দিতেন কত প্রবৃদ্ধি হবে। প্রবৃদ্ধি কম হতে পারে, এমন ধারণা হলে তা বাড়ানোর জন্য প্রভাব খাটানো হতো। তিনি আরও বলেন, মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান নিয়ে টালবাহানা বা নয়ছয় হতো। মূল্যস্ফীতির তথ্য–উপাত্তে কারসাজি করা হলে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। এমন শুনেছি, মূল্যস্ফীতি বেশি দেখানো হলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে চাপ আসত।’
সেলিম রায়হানের মতে, মূল্যস্ফীতি, দারিদ্র্য হার, জিডিপি প্রবৃদ্ধি—এসব পরিসংখ্যান নিয়ে সব সময়ই সরকারের ভয় ছিল। আগের সরকার এসব খাতে একটি চিত্তাকর্ষক চিত্র দিতে চেয়েছে। তাঁর মতে, বিবিএসের নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত সৃষ্টির বিষয়টি নির্ভর করবে রাজনৈতিক মনোভাবের ওপর। তিনি বিবিএসে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের সুপারিশ করেন।
আলোচকেরা যা বলেন
ইউএনডিপির সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি আনোয়ারুল হক বলেন, বিবিএসের ওপর রাজনৈতিক চাপ সব সময়েই থাকবে। কারণ, বিব্রত করে এমন তথ্য–উপাত্ত কখনোই চাইবে না রাজনৈতিক সরকার। কিন্তু বিবিএস কি এই চাপ সামাল দিতে পারবে? ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতিই বিশ্বাসযোগ্য তথ্য–উপাত্ত সৃষ্টিতে সহায়তা করবে।
একটি স্বাধীন পরিসংখ্যান কমিশন গঠনের পরামর্শ দেন রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক বয়ান থাকবে। তবে বিবিএসকে স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিসংখ্যান সৃষ্টি করতে হবে। অতীতে আমলারা রাজনৈতিক বয়ানের সঙ্গে এক হয়ে গেছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তিনটি ‘রোগ’ আছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। এক. রাজনৈতিক বয়ানের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় বিবিএস। দুই. বিবিএসের কারিগরি দক্ষতার সম্মান না দেওয়া। তিন, উন্নয়ন সহযোগীদের কাঙ্ক্ষিত তথ্য–উপাত্ত সৃষ্টিতে বিবিএসের মতো রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে ব্যবহার।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, মূল্যস্ফীতি গণনায় কোন বাজারে কত দাম, সেই তথ্য প্রকাশ করা উচিত। তিনি বলেন, এত দিন নীতিনির্ধারকেরা চোখ বন্ধ করে রাস্তার বাতি বন্ধ করে হেঁটেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম মনে করেন, পরিসংখ্যান আইন সংস্কার করা উচিত। যেকোনো তথ্য–উপাত্ত বিশ্বাসযোগ্য করতে গণশুনানির আয়োজন করার আইনি বাধ্যবাধকতা রাখতে হবে।
বিবিএসের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে যেকোনো সহায়তা দিতে প্রস্তুত বিশ্বব্যাংক, এমন কথা জানান বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি নেত্রা পেলিনোসোয়ামি।
সঠিকভাবে তথ্য–উপাত্ত প্রণয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সিনিয়র সহকারী প্রধান নেপোলিয়ন দেওয়ান।
গত এক বছরে পরিসংখ্যান বদলাতে হস্তক্ষেপ হয়নি
রাজনৈতিক চাপে পরিসংখ্যান পরিবর্তনের অভিযোগ খণ্ডন করেন বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর গত এক বছরে তথ্য–উপাত্ত কারসাজির জন্য ওপর থেকে কোনো চাপ দেওয়া হয়নি। বিবিএসের ওপর কোনো চাপ ছিল না।’ তিনি আরও বলেন, বিবিএসের কাঠামো সংশোধন করা হচ্ছে। আইনে সংশোধনী এনে কোনো তথ্য–উপাত্ত চূড়ান্ত করতে মন্ত্রীর অনুমোদন লাগবে না, এমন বিধান রাখতে পরিকল্পনা উপদেষ্টা সম্মতি দিয়েছেন।
পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম সচিব দিপংকর রায় জানান, জাতিসংঘের নীতিমালা অনুসারে জিডিপি গণনা করা হয়। জিডিপি গণনায় ৮০ শতাংশ তথ্য–উপাত্ত সরকারের অন্য সংস্থার প্রকাশিত তথ্য–উপাত্ত থেকে নেওয়া হয়। মূল্যস্ফীতি গণনায় সংস্কার আনা যেতে পারে।
বিবিএসের পরিচালক (কৃষি শাখা) আলাউদ্দিন আল আজাদ বলেন, ‘আমরা সবাই সংস্কার চাই। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? ২০১২ সালে বিবিএসের সর্বশেষ জনবলকাঠামো পাস করা হয়। কিন্তু ওই কাঠামোর মাত্র ৫৭ শতাংশ জনবল দেওয়া হয়েছে। অস্ত্র-গোলাবারুদ, সৈনিক যদি না দেন, তাহলে যুদ্ধ করব কীভাবে?’
বিবিএসের পরিচালক কবির উদ্দিন আহমেদ বলেন, তথ্য–উপাত্ত সৃষ্টির পদ্ধতি ঠিক করতে বিবিএস কখনো আপস করে না। তবে আরও উন্নতি করার সুযোগ আছে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের স্ট্যাটিসটিকস অ্যান্ড মনিটরিং স্পেশালিস্ট মাহবুব ই আলম, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা এ খান, ইংরেজি দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস–এর পরিকল্পনা সম্পাদক আসজাদুল কিবরিয়া, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল, ইউএন ইউমেন বাংলাদেশের প্রোগ্রাম অ্যানালিস্ট নুবায়রা জেহিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শুভাশিস বড়ুয়া, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবুল বাশার মো. ওমর ফারুক প্রমুখ। বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।