বর্তমান সময়ে আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রধান মুদ্রা মার্কিন ডলারের পরিবর্তে নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ানে বাংলাদেশকে ঋণ দিতে প্রস্তাব দিয়েছে অন্যতম বড় ঋণদাতা দেশ চীন। ঋণের পুরোটা কিংবা আংশিক—দুভাবে ইউয়ানে ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে চীনের এক্সিম ব্যাংক।
মূলত তিন কারণে এখন ইউয়ানে ঋণ দিতে আগ্রহী ব্যাংকটি। কারণগুলো হলো ডলারের বিনিময় হারের ওঠানামা, বৈশ্বিক মুদ্রাবাজারে ইউয়ানের স্থিতিশীলতা ও প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত চীনা ঠিকাদারদের ইউয়ানে মূল্য পরিশোধের দাবি। ইউয়ানে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের মতামত জানতে চেয়েছে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানটি।
সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকীকে এ–সংক্রান্ত চিঠি দিয়েছেন চীনের এক্সিম ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক লি কিউনজি। চিঠি পাওয়ার পরই নড়েচড়ে বসে ইআরডি।
ঈদের ছুটির আগে এই বিষয়ে মতামত জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ও অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিনকে চিঠি দিয়েছে ইআরডি। এখন পর্যন্ত তাঁদের মতামত পায়নি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এই বিভাগ। মতামত পেলে এক্সিম ব্যাংককে জানিয়ে দেবে ইআরডি।
বর্তমানে দেশে চীনা অর্থায়নে সাতটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, এসব প্রকল্পের জন্য মোট ৭৬৪ কোটি ডলার দিচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। প্রেফারেন্সিয়াল বায়ার্স ক্রেডিটের (পিবিসি) আওতায় এসব ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। এই ঋণের একটি শর্ত হলো চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসব প্রকল্পে কাজ করবে।
চলমান সাতটি প্রকল্পের মধ্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অর্গানাইজেশন অব টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ফর ডিজিটাল কানেকটিভিটি প্রকল্পে সাড়ে ২২ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে চীন। এই প্রকল্পের কিছু অর্থ ইতিমধ্যে দেওয়া হয়েছে। ইআরডির চিঠি অনুযায়ী, বাকি অর্থ ইউয়ানে দিতে চায় এক্সিম ব্যাংক। এ ছাড়া প্রেফারেন্সিয়াল বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় ভবিষ্যতে যত ঋণ দেওয়া হবে, তার আংশিক বা পুরোটাই ইউয়ানে দিতে আগ্রহী চীনা ব্যাংকটি।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, চীনের এই প্রস্তাব বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে ঋণের আংশিক ইউয়ানে দেওয়া হলে কোনো অসুবিধা হবে না। কারণ, চীনের ঠিকাদার কাজ করবেন। এতে সহজেই তাঁদের অর্থ পরিশোধ করা যাবে।
তবে আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, ডলার কিংবা ইউয়ান দুই ধরনের মুদ্রাতেই ঋণ পরিশোধের সুযোগ রাখা উচিত। ‘যখন ঋণ পরিশোধ করব, তখন যে মুদ্রায় সুবিধা হবে, তাতেই পরিশোধ করা যাবে,’ বলেন তিনি।
আহসান এইচ মনসুরের মতে, বিশ্ববাজারে চীনের মুদ্রা ইউয়ানের জনপ্রিয়তা ও গভীরতা কম। তবে ইউয়ানের জনপ্রিয়তা ও গভীরতা বাড়াতে চাইছে চীন। তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্য ক্ষতিকর না হলে আমরা ইউয়ানে বাণিজ্য করতে পারি।’
চিঠির ভাষ্য অনুযায়ী, এক্সিম ব্যাংক তিন কারণে ইউয়ানে ঋণ দিতে চায়। চিঠিতে বলা হয়েছে, মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ওঠানামা করছে। এর ফলে ডলারে অর্থায়ন খরচ বেড়ে গেছে। অন্যদিকে ডলারের স্বল্পতা দুই দেশের সহায়তা কর্মসূচির ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এসডিআরের মূল্যমান নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইউয়ানকে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
চিঠিতে বলা হয়, চীনা মুদ্রা ইউয়ান কয়েক বছর ধরেই স্থিতিশীল অবস্থায় আছে, যা মার্কিন ডলারের বিপরীতে অনেক কম ঝুঁকিপূর্ণ।
এক্সিম ব্যাংকের চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী চীনা ঠিকাদারদের সব সময়ই দাবি থাকে, ইউয়ানে যেন বিল পরিশোধ করা হয়। সার্বিকভাবে ইউয়ানে ঋণ দেওয়া হলে বিনিময় হারের খরচ কমাবে, যা প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ কমাতে কাজ করবে।
ইআরডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এটি একটি নীতি সিদ্ধান্তের বিষয়। ঋণ গ্রহণ, ঋণ পরিশোধ—এসব মুদ্রা ব্যবস্থাপনা অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক করে। তাই ওই দুই সংস্থার কাছে মতামত চাওয়া হয়েছে। মতামত পেলেই এক্সিম ব্যাংককে জানিয়ে দেওয়া হবে।