শ্বেতপত্র কমিটির ব্রিফিংয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
শ্বেতপত্র কমিটির ব্রিফিংয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

রাজনীতির কাছে জিম্মি ছিল আমলাতন্ত্র, শ্বেতপত্র কমিটির সঙ্গে বৈঠকে বললেন আমলারা

বিগত সরকারের আমলে জনপ্রশাসন সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির কাছে জিম্মি ছিল। আমলাতন্ত্রের পেশাগত কাঠামো ভেঙে ফেলা হয়েছিল। পেশাভিত্তিক সমিতিগুলো রাজনীতিকরণের কবলে পড়েছিল। সুবিধাবাদী রাজনীতির অংশ হওয়ায় নেতৃত্ব যৌথভাবে পেশাগত সুরক্ষা দিতে পারেনি। যাঁরা সাহস করে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা পেশাগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

আজ রোববার অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সঙ্গে এক সভায় উন্নয়ন প্রকল্পে ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে সরকারের সচিবেরা এমন মন্তব্য করছেন। রাজধানীর পরিকল্পনা কমিশনের একনেক সম্মেলনকক্ষে সভা শেষে ব্রিফিংয়ে এসব কথা জানান শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি জানান, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা স্মরণ করিয়ে আমলারা নিজেদের অসহায়ত্বের কথা বলেছেন।

শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের সঙ্গে চার ঘণ্টাব্যাপী সভায় ৮৫ জন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা অংশ নেন। এর মধ্যে সচিব ও সিনিয়র সচিব ছিলেন ৩২ জন। অন্যদিকে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির ১২ সদস্যের অধিকাংশ সরাসরি সভায় উপস্থিত ছিলেন। বাকিরা অনলাইনে যোগ দেন।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিগত সরকারের আমলে উন্নয়নের যে বয়ান দেওয়া হয়েছে, তা গভীর করার ক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকা ছিল। উন্নয়ন প্রকল্পে যে অর্থ লুণ্ঠন হয়েছে, তাতে প্রশাসনের কী ভূমিকা ছিল—এমন প্রশ্নের জবাবে কর্মকর্তারা বলেছেন, অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবের মুখে পড়তে হয়েছে। প্রকল্প প্রণয়নে গাফিলতি থাকায় প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বেড়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাইপ্রক্রিয়ায় দুর্বলতা ছিল। অনেক ক্ষেত্রে আবার ইচ্ছা করে দুর্বল প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। অনেক প্রকল্প ভুলভাবে টেকসই দেখানো হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনের কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের ত্রিমুখী সংযোগের মাধ্যমে প্রকল্প চয়ন, প্রণয়ন, ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়ন এবং মূল্যায়নের কারণে সমস্যা দেখা দিয়েছে।

আমলাদের বরাত দিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমলাদের মধ্যে যাঁদের রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল, তাঁরা বিভিন্ন ধরনের কাজ করে অন্যদের ওপর কর্তৃত্ব করেছেন। কেউ কেউ প্রতিবাদ করলে তখন শীর্ষ আমলারা চাপ সৃষ্টি করে ভিন্নমত চাপিয়ে দিয়েছেন।

আলোচনায় হাইটেক পার্ক, কর্ণফুলী টানেল, জ্বালানি খাত, কর আহরণ, সামাজিক খাত, ব্যাংক ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলো আসে। ব্যাংকব্যবস্থায় সরকারের ভূমিকা ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ নিয়েও কথা হয় বলে জানান শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমলারা মনে করেন, পেশাদারি উন্নয়ন দরকার। ভবিষ্যৎ উন্নয়নে পেশাগতভাবে দক্ষ আমলাতন্ত্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এটা যেমন কেন্দ্রীয়ভাবে, তেমনি স্থানীয় পর্যায়েও গুরুত্বপূর্ণ। তুলনামূলক স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ চেয়েছেন তাঁরা। ভবিষ্যতে সক্ষমতা, সদিচ্ছা, সমন্বয়—তিনটি ক্ষেত্রেই গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করেন আমলারা।’

প্রকল্পে কী ধরনের দুর্নীতি হয়েছে, জানতে চাইলে শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প হওয়ার আগেই জমি কেনা হয়েছে। জমির দাম তিন গুণ হবে, এমনটা মনে করে আগেই দাম বাড়ানো হয়েছে। যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অনলাইনভিত্তিক দরপত্রপ্রক্রিয়ার মধ্যেও দুর্নীতি হয়েছে। ঠিকাদার নিয়োগে অপকর্ম হয়েছে। আবার কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই প্রকল্প সমাপ্ত করা হয়েছে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রকল্পের আর্থিক ব্যবস্থাপনা মূল্যায়ন করে। তবে প্রকল্পের ফলাফল মূল্যায়ন করা হয় না। ফলে প্রকল্পের মানুষ সুবিধা পেল কি পেল না, সেটি জানা যায় না। আইএমইডিতে তিন ধরনের সমস্যা আছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, আইএমইডির প্রকল্প মূল্যায়ন আধুনিক না; যৌক্তিক না। তাদের মূল্যায়নের ওপর কোনো শাস্তি বা অভিশংসন করা হয় না।

এ বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আইএমইডির যেসব কর্মকর্তা ঠিকমতো প্রকল্পের মূল্যায়ন করেছেন, তাঁরা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। কর্মকর্তাদের ইঙ্গিত দেওয়া হতো, প্রকল্প মূল্যায়নে দেখাতে হবে আর্থসামাজিক যে ফলাফল আশা করা যাচ্ছে, তা পাওয়া যাবে।

আমলারা নিজেদের দায় এড়ালেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির আরেক সদস্য সেলিম রায়হান বলেন, রাজনীতি ঠিক না হলে আমলাতন্ত্র মুক্ত হবে না। গণতান্ত্রিক চর্চা থাকতে হবে। রাজনীতিমুক্ত থাকলে আমলাতন্ত্রও পেশাদারি দেখাতে পারবে।

দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা জানতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। এ কমিটি ৯০ দিনের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেবে বলে কথা রয়েছে।