গত সেপ্টেম্বর মাসে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। এই আয় গত ৪১ মাসের মধ্যে সবনিম্ন। প্রবাসী আয় ধারাবাহিকভাবে কমছে এমন এক সময়ে, যখন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত প্রতিনিয়তই কমছে। প্রবাসী আয় বাড়াতে যে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে, তা এখন আর কাজ করছে না বলেই মনে হচ্ছে। প্রবাসী আয়ে কেন এই অধোগতি, কী করা প্রয়োজন, তা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসী আয় ধারাবাহিকভাবে কমেছে। সেপ্টেম্বর মাসে যে পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছে, তা গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। বর্তমানে প্রবাসী আয়ের যে চিত্রটা দেখতে পাচ্ছি, তা মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়। এ বিষয়ে আমরা অনেক আগেই বিভিন্ন মাধ্যমে সরকারকে আভাস দিয়েছিলাম।
আমি মনে করি, প্রবাসী আয় কমার পেছনে প্রধান কারণ হলো অর্থ পাচারের প্রবণতা। সামনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। স্বাভাবিকভাবে এখন অনিশ্চয়তা অনেক বেশি থাকে। ফলে যারা বিভিন্নভাবে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছে, তাদের একটা অংশ এ সময় সেই অর্থ পাচারের চেষ্টা করছে।
এর আগেও প্রতিটি নির্বাচনের সময়ে এ ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে। তবে এ বছর অনিশ্চয়তাটা একটু বেশি। ফলে পাচারের পরিমাণটাও একটু বেশিই হবে। যারা অর্থ পাচার করে, তাদের জন্য ডলারের দর কত, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেকোনো দরেই তারা রাজি থাকে। কিন্তু এর ফলে ডলারের দাম বেড়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে প্রবাসী আয়ে। অর্থ পাচার বড় ভূমিকা রাখছে প্রবাসী আয় কমার পেছনে। অর্থাৎ যারা অর্থ পাচার করছে, তারাই প্রবাসী আয়ের ডলার নিয়ে নিচ্ছে।
প্রবাসী শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরা দেশে বসে প্রবাসী আয়ের টাকা ঠিকই পাচ্ছেন। মোটামুটি ভালো দরেই তাঁরা এটা পাচ্ছেন। কিন্তু প্রবাসী আয়ের এই ডলার বাংলাদেশ সরকার পাচ্ছে না। আর এর প্রভাব পড়ছে দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্ট, রিজার্ভ ও বিনিময় হারের ওপরে।
প্রবাসী আয় কমার পেছনে দ্বিতীয় যে কারণ হলো, আন্তব্যাংক ও কার্ব মার্কেটের (খোলাবাজারের) মধ্যে ডলারের দরের বড় পার্থক্য। দুই দরের মধ্যে এখনো ব্যবধান প্রায় সাত টাকার মতো। এটা অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে প্রবাসী আয় পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করে। মুদ্রার বিনিময় হারের পার্থক্য আরও কমাতে পারলে প্রবাসী আয় কিছুটা বাড়তে পারে।
অন্যদিকে প্রবাসী আয় পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে অর্থের অপচয়। প্রণোদনার বিষয়টি একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এ নিয়ে আমরা প্রথম দিন (প্রণোদনা ঘোষণার পর) থেকেই বলে আসছি। আমার মতে, প্রণোদনা দেওয়া মানে টাকা পানিতে ঢালা। এটা অর্থের সম্পূর্ণ অপচয়। অদূরদর্শিতার কারণে সরকার পাঁচ-ছয় হাজার কোটি টাকা পানিতে ফেলছে।
এই পরিস্থিতি হয়তো আরও কয়েক মাস চলতে থাকবে। নির্বাচনের আগপর্যন্ত এ অবস্থার শিগগিরই কোনো পরিবর্তন হবে বলে আমি মনে করি না। সম্ভবত পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। নির্বাচনের পরে যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়, তখন আবার প্রবাসী আয় বাড়বে।
এই পরিস্থিতিতে করণীয় হলো, নির্বাচন পর্যন্ত রিজার্ভ লসটা যেন ম্যানেজেবল হয়, সেই চেষ্টা করা। বর্তমানে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের মতো রিজার্ভ রয়েছে। সেটা যেন ১৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে না নামতে দেওয়া হয়। দরকার হলে বন্ধু কোনো দেশ থেকে সফট লোন হিসেবে রিজার্ভ সহায়তা ঋণ নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
আর সরকারের যদি সৎ সাহস থাকে, তাহলে যারা টাকা পাচার করছে, তাদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ যেন নেয়। এটা করা গেলে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে একটা বার্তা যাবে, তাতে প্রবাসী আয়ও বাড়বে।