সমছু মিয়ার বয়স ৭০ ছুঁই ছুঁই। কৈশোরেই পূর্বপুরুষদের মতো আগর-আতর ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। এরপর ৩৫ বছর কাটান মধ্যপ্রাচ্যে। সেখানেও এই ব্যবসা করেন। আবার দেশে ফিরেও জীবিকা উপার্জনের জন্য আগর-আতরের ব্যবসায় নামেন। কিন্তু গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সুগন্ধি তরল আতরের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। সেই তুলনায় আতরের দাম বাড়েনি। ফলে ক্ষতির মুখে পড়েছেন বলে জানান তিনি।
এ অবস্থা শুধু সমছুর একার নয়, মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার সুজানগর গ্রামের ছোট-বড় প্রায় ৩০০ আগর-আতর ব্যবসায়ী এখন বিপাকে। কারণ, গ্যাসের দাম বেড়েছে। তাই তাঁরা চা-শিল্পের সমান দামে গ্যাস পেতে চান। পাশাপাশি ব্যবসায়ীরা এই এলাকার আগর-আতরের জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) স্বীকৃতি দাবি করেছেন। এ জন্য তাঁরা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরে আবেদন করেছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, সুজানগরে প্রায় ৫০০ বছর ধরে আগর-আতরের ব্যবসা হচ্ছে। এখানকার আগর-আতর মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ জাপান ও চীনে রপ্তানি হয়।
আলাপকালে ব্যবসায়ী সমছু বলেন, ‘একসময় বাবা করতেন। এরপর নিজে জড়িয়ে যাই। কিন্তু এখন ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই মুশকিল। আগে বাণিজ্যিক হারে প্রতি ঘনফুট গ্যাসের দাম দিতাম ২৬ টাকা। এখন দিচ্ছি ৩০ টাকা। মাসে প্রায় ৩০ হাজার টাকার গ্যাস বিল দিই। এর সঙ্গে শ্রমিকদের মজুরিও বেড়েছে। আতর বিক্রি করে যা মিলে, তাতে উৎপাদন খরচই ওঠে না।’
সমছু জানান, তাঁর কারখানায় ১২ জন শ্রমিক করেন। মাসে কম-বেশি ১২ তোলা আতর উৎপাদিত হয়। প্রতি তোলা ((১১.৬৬ গ্রাম) আতর বিক্রি করে প্রায় ছয় হাজার টাকা পান।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের কেউ বাড়ির উঠানে আগরগাছ কাটছেন, আবার কেউ ব্যস্ত রয়েছেন কারখানায় আতর তৈরির কাজে। তাঁরা জানান, এই গ্রামে আগর-আতর কারখানা আছে ২৫০টি।
বাংলাদেশ আগর-আতর প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি আনছারুল হকের কারখানায় তাঁর ছেলে এমদাদুল হককে শখানেক নারী ও পুরুষ শ্রমিক নিয়ে কাজ করতে দেখা যায়। বড় এই কারখানায় ১১টি ডেকচিতে তরল আগর উৎপাদিত হয়। এমদাদুল হক বলেন, আগরগাছের কোনো কিছুই ফেলনা নয়। গ্যাসের চুলায় জ্বাল দিয়ে আগর কাঠ থেকে সুগন্ধি আতর তৈরি হয়। আতরের পাশাপাশি কাঠের ছোবড়াও বিদেশে রপ্তানি হয়।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, সুজানগরে পেরেক মারা আগরগাছ থেকেই আতর তৈরি করা হয়। ব্যবসায়ীদের অনেকের আগরগাছের বাগান রয়েছে। কেউ কেউ বাইরের লোকজনের কাছ থেকে গাছ কেনেন। আগরগাছের বয়স ছয়-সাত বছর হলেই পুরো গাছে এক ইঞ্চি পরপর পেরেক মারা হয়।
তখন গাছ থেকে একধরনের রস বের হয়। পেরেকের চারপাশে সেই রস জমে কালো রং ধারণ করে। এভাবেই তিন থেকে পাঁচ বছর রাখা হয়। এরপর গাছ কাটা হয়। ছোট ফালি করে কাটার পর পেরেক খোলা হয়। তখন গাছের কালো ও সাদা অংশ আলাদা করা হয়। সেই কাঠ কারখানার হাউস কিংবা প্লাস্টিকের ড্রামে রাখা পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় এক থেকে দেড় মাস। তারপর সেগুলো স্টিলের ডেকচির মধ্যে দিয়ে অনবরত জ্বাল দেওয়া হয়। তখন পাতন পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট পাত্রে ফোঁটায় ফোঁটায় আতর পড়ে জমা হয়।
ব্যবসায়ীরা বলেন, ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত আগর উৎপাদন চলে। কারণ, এ সময়টা শুষ্ক থাকে। গাছ থেকে আগর সংগ্রহ সহজ হয়। বর্ষায় গাছে পানি জমে থাকে। তখন আগর সংগ্রহ কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া আগরের মানও ভালো থাকে না।
আগর-আতর প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কবির আহমেদ চৌধুরী জানান, একেকটি কারখানায় মাসে এক থেকে পাঁচ লিটার তরল আতর উৎপাদিত হয়। মানভেদে এক তোলা আতর ৬ থেকে ১০ হাজার টাকায় বিদেশে রপ্তানি হয়।
কবির আহমেদ বলেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে চাইছেন। সরকার আগর-আতরকে ক্ষুদ্র শিল্প ঘোষণা করেছে। সে জন্য চা-শিল্পের হারে আগর-আতর শিল্পে গ্যাস দেওয়ার জন্য গত জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত আবেদন করা হয়েছে। বর্তমানে চা-শিল্পে প্রতি ঘনফুট গ্যাসের মূল্য ১১ টাকা ৯৩ পয়সা। অথচ আগর-আতর শিল্পে ৩০ টাকা।
মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) প্রভাংশু সোম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বহির্বিশ্বে মৌলভীবাজারের আগর-আতরের বেশ সুনাম রয়েছে। আগর-আতর শিল্পে গ্যাসের মূল্যহ্রাস ও জিআই স্বীকৃতির বিষয়ে তাঁদের কার্যালয়ে কেউ আবেদন করেছেন কি না, সেটা খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।
আগর-আতরকে একটি ‘প্রতিষ্ঠিত শিল্প’ হিসেবে উল্লেখ করেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) মহাপরিচালক-১ মাহবুবুর রহমান। গত শনিবার মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘আমরা আগর-আতর শিল্পের উন্নয়নে প্রাথমিক কিছু কাজ করেছিলাম। আগরগাছের বাগান তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ফাঁকা বনভূমি না পাওয়ায় সেটা সম্ভব হয়নি। বনভূমি থেকে গাছ কাটাও নিষিদ্ধ। আর ব্যক্তিগত জমিতে বাগান করার জন্য উদ্যোক্তা শ্রেণি মেলেনি। আগর-আতর ব্যবসায়ীরা যাতে ভালো মানের পণ্য উৎপাদন করতে পারেন, সে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’