খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০%–এর বেশি

এই অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ, যা অর্থবছরওয়ারি হিসাবে অন্তত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ।

গত এক যুগের মধ্যে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি চাপে ছিলেন। এই চাপ মূল্যস্ফীতির। সাধারণ মানুষ বাজারে গিয়ে তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। এখনো চাপটা অব্যাহত আছে। এ জন্য সরকার দফায় দফায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি, মূল্যস্ফীতিও কমেনি। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ, যা অর্থবছরওয়ারি হিসাবে অন্তত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। পুরো বছরে কোনো মাসেই সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের নিচে নামেনি।

আরও খারাপ খবর হলো, গত ১২ মাসের মধ্যে ৭ মাসই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। গত বছরের আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে উঠেছিল, যা অর্থবছরের সর্বোচ্চ।  

বিদায়ী অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে রাখার লক্ষ্য ছিল সরকারের। বছর শেষে দেখা গেল, সেই লক্ষ্যের ধারেকাছেও নেই। এমনকি মূল্যস্ফীতি কমারও কোনো লক্ষণ নেই। 

দেশে দুই বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। এর মধ্যে দেড় বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তাতে লাভ হয়নি। বরং মূল্যস্ফীতি উচ্চ স্তরেই রয়েছে, মাঝেমধ্যে সামান্য ওঠানামা করে। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা মনে করেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখন দেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।

সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে, প্রকৃত আয় কমছে। খরচে কুলাতে না পেরে মধ্যবিত্ত সঞ্চয় ভাঙছে কিংবা খাদ্যবহির্ভূত খাতে খরচ কমাচ্ছে। 
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম গবেষণা পরিচালক, সিপিডি

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা বলেন, মূল্যস্ফীতি একধরনের কর; যা ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবার ওপর চাপ সৃষ্টি করে। আয় বৃদ্ধির তুলনায় মূল্যস্ফীতির হার বেশি হলে বিশেষ করে গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষ সংসার চালাতে গিয়ে অত্যধিক ভোগান্তিতে পড়েন। দুই বছর ধরে চলা এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবনযাপনে।

এদিকে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, প্রকৃত মূল্যস্ফীতি বিবিএসের প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে বেশি।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন চলছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির ওপর উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে, প্রকৃত আয় কমছে। খরচে কুলাতে না পেরে মধ্যবিত্ত সঞ্চয় ভাঙছে কিংবা খাদ্যবহির্ভূত খাতে খরচ কমাচ্ছে। অন্যদিকে অতিগরিব মানুষেরা খাবার কেনা কমিয়ে দিচ্ছেন।’

গোলাম মোয়াজ্জেম দুটি পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর মতে, সরকারকে মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের হাতে থাকা কৌশলগুলো পুরোপুরি ব্যবহার করা হয়নি। অন্যদিকে গরিব মানুষের জন্য সুরক্ষা কর্মসূচি কার্যকরভাবে বিস্তৃত করতে হবে। তিনি বলেন, সরকার নানা ধরনের সুরক্ষা কর্মসূচি নিলেও প্রকৃত সুবিধাভোগীরা তা পাচ্ছেন না। ফলে সরকারের ভালো উদ্যোগও কাজে আসছে না। 

জুন মাসে মূল্যস্ফীতি ৯.৭২%

গত জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ হয়েছে। এর আগের মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতিও জুনে সামান্য কমেছে, তবে তা তিন মাস ধরে ১০ শতাংশের বেশি আছে। জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৪২ শতাংশ, যা মে মাসে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং তার আগের মাস এপ্রিলে তা ছিল দুই অঙ্কের ঘরে, ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। গতকাল রোববার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে।

মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭২ শতাংশের মানে হলো, গত বছরের জুন মাসে যেসব পণ্য ও সেবা কিনতে একজন ভোক্তাকে ১০০ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে, সেগুলো কিনতে চলতি বছরের জুনে খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৯ টাকা ৭২ পয়সা। মূল্যস্ফীতি বাড়লে নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের কষ্ট সবচেয়ে বেশি বাড়ে। তাঁদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়।

বিবিএসের হিসাব অনুসারে, জুন মাসে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৯ দশমিক ১৫ শতাংশ হয়েছে, যা এর আগের মে মাসে ছিল ৯ দশমিক ১৯ শতাংশ। 

খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৭ মাসই ১০%–এর বেশি 

দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, গত ১২ মাসের মধ্যে সাত মাসই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি ছিল। এই মাসগুলো হলো গত বছরের আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর; চলতি বছরের এপ্রিল, মে ও জুন। 

অন্যদিকে অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এরপর তা কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে। গত অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সর্বনিম্ন ৯ দশমিক ৪১ শতাংশে নেমেছে এবং সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে উঠেছে।

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং দেশে মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন খরচও বেড়েছে। ফলে পণ্যের দাম বেড়ে জনগণের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এক যুগে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল ২০১২ সালের মার্চ মাসে, যা পরের মাসে অবশ্য ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে নেমে আসে। এরপর আর কখনো মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে যায়নি। 

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ হলো, সুদের হার বাড়ানো বা বাজারভিত্তিক করা; জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যে শুল্ক-কর কমিয়ে দাম কিছুটা কমানো এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় যে অনিয়ম রয়েছে তা দূর করতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও প্রতিযোগিতা কমিশনসহ সরকারি সংস্থাগুলোকে আরও বেশি সক্রিয় করে তোলা।