গতকাল রাজধানীতে বিশ্বব্যাংক ও সানেম আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি রিজার্ভসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন।
দেশের অর্থনীতিতে যে সংকট রয়েছে, তা মোকাবিলায় সংস্কার করতেই হবে। রাজনৈতিক কারণে এখনই স্বল্প মেয়াদে সংস্কার শুরু করা সম্ভব না–ও হতে পারে। তবে নির্বাচনের আগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত যাতে কোনোভাবে ১৫ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের নিচে না নামে, সেই উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে অন্য কোনো দেশ থেকে ঋণ নিয়ে রিজার্ভ ভালো রাখতে হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে কে ক্ষমতায় আসবে, সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। নির্বাচনের পর অর্থনীতিতে সংস্কার কার্যক্রম শুরু করতেই হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ বিষয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে এমন মত দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, করনীতিতে সংস্কার শুরু করতে হবে। এ জন্য তিন থেকে পাঁচ বছর সময় প্রয়োজন হবে। বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার ব্যবস্থাপনাসহ সুদহার বাজারভিত্তিক ও রপ্তানি বহুমুখী করার উদ্যোগ নিতেই হবে। এসব না করলে অর্থনীতিতে সংকট আরও বাড়তে পারে। নিয়ন্ত্রিত বাজারব্যবস্থা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। এভাবে চলতে থাকলে সামনে অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার সুযোগ না–ও মিলতে পারে।
সামনের দুই-তিন মাস অর্থনীতির জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং সময়। অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা ছেলেখেলা নয়। এটা অপ্রত্যাশিতভাবে আরও অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। এ জন্য সংস্কারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও বিশ্বব্যাংক যৌথভাবে গতকাল রোববার এই সেমিনারের আয়োজন করে। এতে মূল প্রবন্ধে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান অর্থনীতিবিদ ফ্রানসিসকা লিসেলোতা অনেসোর্স বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় বেশির ভাগ দেশের প্রবৃদ্ধির গতি কমে গেছে। বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় কাঠামোগত সমস্যা বিদ্যমান।
সেমিনারে প্যানেল আলোচনায় আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থনীতিতে টানাপোড়েন শুরু হওয়ার পর দেড় বছর চলে গেল, কিন্তু সরকার কোনো সংস্কারের উদ্যোগ নেয়নি। ‘ভালো করছি, ভালো হয়ে যাবে’, এমন বক্তব্যে সময় চলে যাচ্ছে। বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চলায় আজ দেশের এই অবস্থা। ১০ বছর ধরে করনীতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু সংস্কার করা হয়নি। সমস্যা ঠিকই চিহ্নিত, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এই সংকটে যে ধরনের ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন ছিল, তা করা হয়নি। এটা স্বাভাবিক বিষয় না, রাজনৈতিক কারণে এটা নেওয়া হয়নি।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এত কম কর-জিডিপির হার দিয়ে কীভাবে এত ঋণ শোধ হবে, সেটা বোধগম্য না। সরকার সফলভাবে সরকারি খরচ কমাতে পেরেছে, কিন্তু কর আদায় করতে পারছে না। অনেকেই সরকারি ঋণ নিয়ে স্বস্তিতে আছেন, তবে পরিশোধের সক্ষমতা কম। এ জন্য কর ব্যবস্থাপনা অবশ্যই স্মার্ট হতে হবে। যদি আমরা দেশীয় খাত থেকে ঋণ নিয়ে চলতে চাই, তাহলে ভালো আর্থিক খাত প্রয়োজন হবে, যাতে এই ঋণ শোধ করা যায়।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের ব্যাংক ব্যবস্থাপনা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বন্ড বাজারও শক্তিশালী না। সুদহার বাজারভিত্তিক না হওয়ায় বন্ডবাজারে লেনদেন কম। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দিয়েছে। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। পাশাপাশি ডলারের দাম ধরে রাখায় হঠাৎ ডলারের দামও বেড়ে গেছে।
অপর প্যানেল আলোচক ঢাকা চেম্বারের সভাপতি সামির সাত্তার বলেন, ‘আমাদের প্রধান সমস্যা করের হার কম। ৯০ শতাংশ কর ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে আসছে। কিন্তু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ৪৮ শতাংশ হয় এই দুই শহরে। অনেকেই করজালের বাইরে রয়ে গেছেন। এ জন্য এনবিআরকে সারা দেশে যেতে হবে। করনীতির সংস্কার করতে হবে। এ ছাড়া অনানুষ্ঠানিক খাত বড় হচ্ছে। তাদের করের আওতায় আনতে হবে। কর নিয়ে বেসরকারি খাতের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি উচ্চ, কিন্তু জিডিপির তুলনায় করহার কমছে। তার মানে কর ব্যবস্থাপনার বাইরে অনেকেই রয়ে গেছেন। এর কারণ, কর ব্যবস্থাপনা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত। এখন মূল্যস্ফীতি বেশি, প্রবাসী আয় কমছে। এর সঙ্গে অর্থ পাচারের সম্পর্ক আছে। এবারে অর্থনীতিতে সংকট তৈরি হয়েছে, তা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এটা এমনি এমনি ঠিক হবে না।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, সামনের দুই-তিন মাস অর্থনীতির জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং সময়। অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা ছেলেখেলা নয়। এটা অপ্রত্যাশিতভাবে আরও অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। এ জন্য সংস্কারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। যারা সংস্কারের বিরোধিতা করে, তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সংস্কার আরও বিলম্বে করলে শঙ্কা আরও বাড়বে। এই কারণে শ্রীলঙ্কার অবনতি হয়েছে। রাজনীতির চেয়ে অর্থনীতিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।