প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের নভেম্বরে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভিত্তিফলক স্থাপন করেছিলেন। তাতে দুই উপজেলার মানুষ কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
ভিত্তিপ্রস্তর বা ফলক স্থাপনের পর সাড়ে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও ময়মনসিংহ অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি নেই। ব্রহ্মপুত্র নদের চরাঞ্চলে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কথা, যা জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার রাজীবপুর ও উচাখিলা ইউনিয়নে অবস্থিত। জায়গাটি আবার ত্রিশাল উপজেলার সীমান্তেও পড়েছে। এর ফলে দুই উপজেলার মানুষ অর্থনৈতিক অঞ্চলটিকে ঘিরে নতুন স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু তা বাস্তবায়নে অগ্রগতি না থাকায় স্থানীয় বাসিন্দারা হতাশা প্রকাশ করেছেন।
এ নিয়ে ময়মনসিংহ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি শংকর সাহা বলেন, ‘অর্থনৈতিক অঞ্চলটি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। এটি বাস্তবায়ন না হওয়াটা আমাদের দুর্ভাগ্য। এই অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়নের জন্য চেম্বারের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। কিন্তু অগ্রগতি হচ্ছে না। এটি বাস্তবায়ন হলে শিল্পায়নের পাশাপাশি বহু মানুষের কর্মসংস্থান হতো।’
অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে নতুন কোনো অগ্রগতি নেই। জায়গাটি মাটি ভরাট করে রাখা আছে। নতুন কোনো নির্দেশনা পেলে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী, জেলা প্রশাসক, ময়মনসিংহ।
দেশে বিনিয়োগ আকর্ষণ, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৬ সালের এপ্রিলে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) নতুন করে ৯টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান চূড়ান্ত করে। এর মধ্যে সরকারিভাবে পাঁচটি ও বেসরকারি উদ্যোগে বাকি চারটি বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। এই ৯টিরই একটি ময়মনসিংহ অর্থনৈতিক অঞ্চল, যেটি সরকারি উদ্যোগে নেওয়া হয়েছিল। ২০১৮ সালের ২ নভেম্বর ময়মনসিংহের সার্কিট হাউস ময়দানে আয়োজিত এক জনসভায় যোগ দেওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০৩টি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করেন। এর মধ্যে ময়মনিসংহ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভিত্তিফলকও উদ্বোধন করেছিলেন।
ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক (ডিসি) দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে নতুন কোনো অগ্রগতি নেই। জায়গাটি মাটি ভরাট করে রাখা আছে। নতুন কোনো নির্দেশনা পেলে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
স্থানীয় ভূমি অফিসের নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৬ সালের ১৬ মে ৪৮৭ দশমিক ৭৭ একর জমি নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। এর মধ্যে ৪৫৪ দশমিক ৮৪ একর বন্দোবস্ত ও ৩২ দশমিক ৯৩ একর অধিগ্রহণ করার কথা। ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট ভূমি মন্ত্রণালয় বেজার অনুকূলে সেই জমি বন্দোবস্ত দিতে ও প্রয়োজনী কিছু তথ্য চেয়ে জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয়। একই মাসে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটির স্থান পরিদর্শন করে। তারা কিছু জমি ব্রহ্মপুত্র নদে বিলীন হয়ে যাওয়ায় নতুন করে প্রস্তাব পাঠানোর নির্দেশ দেয়। পরে ওই বছরের ২৪ অক্টোবর ৪৯২ দশমিক ৩৬ একর জমি নিয়ে নতুন করে প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধিশাখা-২ থেকে ২০২০ সালের ১ মার্চ পাঠানো এক চিঠিতে জানানো হয়, ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার চররামমোহন মৌজায় ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত বিভিন্ন দাগের ৪২৩ দশমিক ৬১ একর খাস জমি ময়মনসিংহ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে বন্দোবস্ত দেওয়ার জন্য প্রস্তাব পাঠানো হলেও প্রস্তাবিত জমি নিয়ে মামলা চলছে। তাই বন্দোবস্ত দেওয়ার আইনগত সুযোগ নেই।
পরে ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নতুন একটি চিঠি দেওয়া হয়। তাতে মামলার কারণে জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার সুযোগ না থাকায় ২০০ একর জমি নিয়ে বিকল্প প্রস্তাব জমা দিতে বলা হয়। সে অনুযায়ী ২০২২ সালের ৫ জুন তৎকালীন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) বিকল্প হিসেবে নিষ্কণ্ঠক ২০০ একর জমির প্রস্তাব জেলা প্রশাসনের কাছে জমা দেন। তারপর অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য নির্বাচিত স্থানে ব্রহ্মপুত্র নদ খনন করে বালু ফেলে উঁচু করা হয়েছে। এর বাইরে দৃশ্যমান আর কোনো অগ্রগতি নেই।
উচাখিলা মরিচারচর গ্রামের বাসিন্দা নূরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যক্রম শুরু হলে স্থানীয় অনেকের জীবিকার ব্যবস্থা হবে, এমন আশাই করেছিলাম আমরা। কিন্তু কাজ আগায়নি। এই অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়ন হবে কি হবে না, তা বলতে পারছি না। তবে অর্থনৈতিক অঞ্চলটি বাস্তবায়িত হলে ব্রহ্মপুত্র নদের পারের মানুষের জীবন পাল্টে যেত।’
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ইকবাইল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ২০০ একর জমির বন্দোবস্তের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, সে অনুযায়ী অধিগ্রহণ করতে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। এটি হয়তো এখনো মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
ময়মনসিংহ-৮ (ঈশ্বরগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ হাসান সুমন বলেন, প্রধানমন্ত্রী অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করলেও ভূমিসংক্রান্ত জটিলতায় সেটি বাস্তবায়নে অগ্রগতি নেই। এ অঞ্চলে কোনো অর্থনৈতিক অঞ্চল না থাকায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত অর্থনৈতিক অঞ্চলটি বাস্তবায়িত হলে এলাকায় মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, বেকারত্ব দূর হবে, মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে। দ্রুত যেন এটি বাস্তবায়ন হয়, সে জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।