অর্থনীতিতে বড় দুশ্চিন্তার বিষয়গুলোর একটি হচ্ছে বেসরকারি বিনিয়োগ। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি থমকে যাবে।
ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম এখন ১১৭ টাকা। বছর দুয়েক আগেও ৮৬-৮৭ টাকায় ডলার কেনা যেত। খুব দ্রুত মান হারিয়েছে টাকা, ফলে প্রচণ্ড চাপে পড়েছে দেশের শিল্প ও ব্যবসা-বিনিয়োগ। ইস্পাত খাতের কথাই ধরা যাক, শুধু ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণেই এই খাতের কোম্পানিগুলো ২৫-৩০ শতাংশ মূলধন হারিয়েছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে কাঁচামাল আমদানি শুল্ক, গ্যাস, জ্বালানি তেল ও সুদের হার বেড়ে যাওয়ার কারণে অতিরিক্ত খরচ।
ইস্পাত খাতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি জিপিএইচ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের কথায়, বিদ্যমান শিল্পকারখানা যখন সঠিকভাবে চলতে পারছে না, লোকসান দিচ্ছে, তখন নতুন বিনিয়োগে কেউ সাহস দেখায় না। আগে একটি কারখানার পরিচালনায় চলতি মূলধন ১০০ কোটি টাকা লাগলে এখন লাগছে ১৬০ কোটি টাকা। কারখানার উৎপাদন সক্ষমতার ৫০-৬০ শতাংশ ব্যবহার হওয়ায় এখন কর্মী কাটছাঁট করতে হচ্ছে। ফলে হচ্ছে না নতুন কর্মসংস্থানও।
পরিস্থিতি অনেকটা একই রকম দেশের প্রায় সব শিল্প খাতের। দাম বাড়ার পরও ডলার–সংকট পুরোপুরি কাটেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, শিল্পের কাঁচামাল থেকে শুরু করে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমছে। পাশাপাশি গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংকটে ভুগছে শিল্পকারখানা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। বাড়ছে না পণ্য রপ্তানির ক্রয়াদেশও। এর ফলে শিল্পকারখানার উৎপাদন কমছে।
নানামুখী সংকটের মধ্যে বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগ ও বিদ্যমান ব্যবসা সম্প্রসারণে গতি নেই। অর্থনীতির এমন পরিস্থিতির মধ্যে ৬ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের যে বাজেট উত্থাপন করতে যাচ্ছেন, তাতে বেসরকারি খাতের কর্মকাণ্ড চাঙা করে কর্মসংস্থান বাড়ানোই মূল চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। আগামী বাজেটের আকার হবে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচক নিয়েই বর্তমানে দুশ্চিন্তা রয়েছে। তার মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ অন্যতম। অনেক দিন ধরেই সরকারি বিনিয়োগ দ্রুত হারে বাড়লেও বেসরকারি বিনিয়োগ সে তুলনায় বাড়ছে না। অর্থনীতির এই সংকটময় সময়ে বিনিয়োগ দ্রুতগতিতে বাড়ানো না গেলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হবে, বাড়বে বেকারের সংখ্যা। অন্যদিকে ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, বিভিন্ন কারণে ব্যবসার খরচ বেড়েছে। তবে ব্যবসা সেভাবে বাড়েনি। মূলধন ঘাটতির কারণে বিদ্যমান ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে ব্যবসা সম্প্রসারণ বা নতুন বিনিয়োগ অধিকাংশ ব্যবসায়ীর অগ্রাধিকার তালিকায় নেই।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে বিনিয়োগকে দেখা হয় মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির অনুপাতে। দেশে জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগের হার ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। তার আগের অর্থবছরে ছিল ২৪ দশমিক ৫২ শতাংশ।
দীর্ঘদিন ধরেই দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির গতি শ্লথ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিসিএস) প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে বিনিয়োগ দাঁড়াবে ১৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি, যা গত বছরের চেয়ে ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রাক্কলন হয়েছে ১১ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা, প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ২০ শতাংশ।
বড় বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির এই প্রাক্কলন করা হলেও পরিসংখ্যান অবশ্য বলছে ভিন্ন কথা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ১৭৭ কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়েছে। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ শতাংশ কম। একইভাবে শিল্পের প্রয়োজনীয় প্রাথমিক কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি কমেছে যথাক্রমে ৪ ও ১৬ শতাংশ। এই আট মাসে ১৫২ কোটি ডলারের কাঁচামাল ও ৩০০ কোটি ডলারের মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি হয়। গত অর্থবছরের এই সময়ে আমদানি হয়েছিল ১৫৮ কোটি ডলারের প্রাথমিক কাঁচামাল ও ৩৬০ কোটি ডলারের মধ্যবর্তী কাঁচামাল।
ব্যবসার পরিবেশে উন্নতি নেই
দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী আনোয়ার গ্রুপ গত বছর প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে ডেনিম কাপড়, ইস্পাত ও কাগজ উৎপাদনে তিনটি কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কারখানা নির্মাণকাজও শুরু হয়। তবে গত বছর দ্বিতীয়ার্ধে অর্থনৈতিক সংকট প্রকট হলে ডেনিম ছাড়া অন্য দুটি কারখানা স্থাপন স্থগিত করে তারা।
আনোয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান মানোয়ার হোসেন সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত আপাতত ইস্পাত ও কাগজ উৎপাদন প্রকল্প স্থগিত থাকবে। যদিও ইস্পাত কারখানায় ইতিমধ্যে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ হয়ে গেছে। তারপরও স্থগিত থাকবে। কারণ হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদ্যমান ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্যবসা করা যে কঠিন হয়েছে, তার প্রমাণ মিলছে ২০২৩-২৪ সালের ব্যবসা পরিবেশ সূচকে (বিবিএক্স)। ২০২২ সালে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসা পরিবেশের সূচকের ১০০ নম্বরের মধ্যে স্কোর ছিল ৬১ দশমিক ৯৫। গত বছর সূচকের স্কোর কমে ৫৮ দশমিক ৭৫–এ নেমেছে। অর্থাৎ এক বছরে দেশে ব্যবসা পরিবেশের অবনতি ঘটেছে।
বিবিএক্স জরিপটি করেছে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) এবং বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ। ব্যবসা শুরু, জমির প্রাপ্যতা, আইনকানুনের তথ্যপ্রাপ্তি, অবকাঠামো সুবিধা, শ্রমনীতি, বিরোধ নিষ্পত্তি, বাণিজ্য সুবিধা, কর পরিশোধ, প্রযুক্তির ব্যবহার, ঋণের প্রাপ্যতা এবং পরিবেশগত নিয়মনীতি ও মান—এই ১০টি সূচকের ওপর ভিত্তি করে জরিপটি করা হয়েছে।
ওই জরিপের তথ্যানুযায়ী, গত এক বছরে ব্যবসায়ীদের ব্যাংকঋণ পাওয়া আরও কঠিন হয়েছে। কর ও ভ্যাট পরিশোধে হয়রানি আগের মতোই রয়েছে। ব্যবসা শুরুর প্রক্রিয়া আগের চেয়ে জটিল হয়েছে। এ ছাড়া আইনকানুনের তথ্যপ্রাপ্তি, অবকাঠামো সুবিধা, শ্রম নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবসায় বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আগের চেয়ে অবনতি হয়েছে।
পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘মজুরি বৃদ্ধি, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটসহ বিভিন্ন কারণে ব্যবসার খরচ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। সরকারের বিভিন্ন সেবা নিতে গিয়েও হয়রানির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ব্যবসা পরিবেশের উন্নতি কিংবা খরচ কমানোর বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আমরা দেখছি না। বর্তমান পরিস্থিতি কোনোভাবেই নতুন বিনিয়োগবান্ধব নয়, বরং বর্তমান ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই বেশ কষ্টের।
বিদেশি বিনিয়োগে ভাটার টান
বেসরকারি বিনিয়োগের মধ্যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০২২ সালে দেশে ৩৪৮ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছিল। আর গত বছর এসেছে ৩০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত বছর এফডিআই কম এসেছে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বা ৪৮ কোটি ডলার।
মোট এফডিআইয়ের মধ্যে মূলধন বা নতুন বিনিয়োগ, পুনঃ বিনিয়োগও কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে যেখানে ১০২ কোটি ডলারের নতুন বিনিয়োগ এসেছিল, গত বছর তা কমে ৭১ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। আর পুনঃ বিনিয়োগ ২০২২ সালে ছিল ২৫১ কোটি ডলারের, গত বছর তা কমে হয়েছে ২২১ কোটি ডলার।
জানতে চাইলে পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, দুই বছর ধরে ডলারের দাম অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। আমদানিতে রয়েছে বিধিনিষেধ। এই দুই কারণে বিদেশিরা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাননি। অন্যদিকে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিবেশে দুর্বলতা রয়েছে। বন্দর থেকে পণ্য খালাসে সময় ও অর্থ বেশি লাগে। সরকারের নীতিতে ধারাবাহিকতার অভাব রয়েছে, বিশেষ করে কর ও কাস্টমসে। সব মিলিয়ে এফডিআই আনতে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে।
গতি নেই নতুন কর্মসংস্থানে
পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়া, জ্বালানিসংকট, মূলধন ঘাটতিসহ বিভিন্ন কারণে তৈরি পোশাক, বস্ত্র, ইস্পাত ও সিমেন্ট খাতের কারখানাগুলোর বড় অংশ পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন করতে পারছে না। তার মধ্যে বস্ত্র খাতে নতুন নিয়োগ বন্ধ। বিভিন্ন কারখানায় ছাঁটাই হচ্ছে এমন তথ্যও মিলছে।
শিল্পে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে। নতুন নিয়োগের বিষয়ে বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি নতুন নিয়োগ তো কল্পনার বাইরে। যদিও প্রতিদিনই চাকরি খুঁজতে কারখানার বাইরে অনেকে আসছে।’
অন্যদিকে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ কারখানায়ই ক্রয়াদেশ কম। তাই নতুন নিয়োগ সেভাবে নেই। বরং কোথাও কোথাও কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে।
দেশে বর্তমানে ২৫ লাখ ৯০ হাজার বেকার আছেন। ২০২৩ সাল শেষে গড় বেকারের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৭০ হাজার। এর মানে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিসিএস) ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বেকার পরিস্থিতি জরিপে তুলে ধরা হয়েছে।
জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনীতিতে সংস্কার না করলে বিনিয়োগ হবে না। বিদেশিরা এ দেশ থেকে চলে যাবে। ব্যাংক খাত, রাজস্ব খাত, স্বাস্থ্য খাত, শিক্ষা খাতে বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে। নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। না হলে এখনকার মতো অর্থ দেশে না এসে বিদেশে চলে যাওয়া অব্যাহত থাকবে। এতে সংকট আরও বাড়বে।
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ‘যেভাবে চলছে এভাবে চলবে—এমনটা ভেবে থাকলে কখনো বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হবে না। এতে করে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে, যা দেশের জন্য ভালো হবে না। এই পরিস্থিতি ভোগ করতে হবে সাধারণ মানুষকে।’