আইএমএফের বিশেষজ্ঞ দল ৪-১৭ মার্চ রাজস্ব আদায় বাড়ানো ও করদাতাদের সহজে কর দেওয়ার উপায়সহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করবে।
দেশের রাজস্ব খাত সংস্কারে সহায়তা দেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। কীভাবে রাজস্ব আদায় বাড়ানো যায়, কোন কোন খাতে জোর দিতে হবে এবং করদাতারা যাতে সহজে কর দিতে পারেন, এসব বিষয়েই সহযোগিতা দেবে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি। এ লক্ষ্যে আইএমএফের একটি বিশেষজ্ঞ দল দুই সপ্তাহের এক সফরে ৪ মার্চ ঢাকা আসবে।
আইএমএফের বিশেষজ্ঞ দলটির বাংলাদেশ সফরকালে কর আদায়ে কোথায় কী সমস্যা রয়েছে, সেটি চিহ্নিত করা হবে। কোথায় করছাড় কমানো হবে, তা–ও বিশ্লেষণ করে দেখা হবে। সার্বিকভাবে রাজস্ব সংস্কারের উদ্দেশ্য নিয়েই আসছে আইএমএফের এই টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স মিশন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, তাঁদের সঙ্গে আইএমএফের বিশেষজ্ঞরা ৪ থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত আলোচনা করবেন। দলটিতে তিনজন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। তাঁরা হলেন আইএমএফের আর্থিকসংক্রান্ত বিভাগের রাজস্ববিশেষজ্ঞ ডেভিড রবার্ট ওয়েন্টওয়ার্থ, অরবিন্দ মোদি ও ডেভিড উইলিয়াম বার। তাঁরা ঢাকায় আসবেন ৩ মার্চ। ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁদের ‘অন অ্যারাইভাল’ ভিসা দেওয়ার জন্য ইমিগ্রেশন বিভাগকে অনুরোধ করেছে এনবিআর।
আইএমএফ মিশনের সঙ্গে দুই সপ্তাহ ধরে শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর—এই তিন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হবে বলে জানান এনবিআরের কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেন, এরপর একটি কৌশলপত্র ঠিক করা হতে পারে।
২০২২ সালের জুলাইয়ে আইএমএফের কাছে ঋণ চায় বাংলাদেশ। ছয় মাস পর ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি সংস্থাটি শর্তসাপেক্ষে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যতম শর্তের মধ্যে রয়েছে দেশের রাজস্ব খাতের সংস্কার। সে অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সংস্থাটির সঙ্গে বাংলাদেশের দফায় দফায় বৈঠক হয়। এর মধ্যে রাজস্ব খাতের আলোচনায় এনবিআরের কর্মকর্তারা রাজস্ব আয় বাড়াতে কিছু খাতের ওপর জোর দেন। অন্যদিকে আইএমএফ চায় কাঠামোগত সংস্কার, যার অন্যতম হলো অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয়–ব্যবস্থা জোরদারে প্রাধান্য দেওয়া।
এবারের মিশনে এনবিআর ও আইএমএফ সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে বসবে। তবে বড় ধরনের সংস্কারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে।আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, আইএমএফের শর্ত পূরণ করা সম্ভব নয়—এটা সংস্থাটি নিজেও বোঝে। কীভাবে শুল্ক-কর আদায় বাড়ানো যায়, তা নিয়ে আগেও দুই পক্ষের আলোচনা হয়েছে। এবারের মিশনে এনবিআর ও আইএমএফ সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে বসবে। তবে বড় ধরনের সংস্কারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে।
আহসান এইচ মনসুরের মতে, রাজস্ব প্রশাসন ও রাজস্ব নীতি—দুই ক্ষেত্রেই সংস্কার লাগবে। অটোমেশনে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে।
২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে আইএমএফের কাছ থেকে সাত কিস্তিতে বাংলাদেশ পাবে মোট ৪৭০ কোটি ডলার। ইতিমধ্যে দুই কিস্তির অর্থছাড় হয়েছে। আগামী জুন মাসের মধ্যে তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে রাজস্ব খাতে দৃশ্যমান তথা বড় সংস্কার করতে হবে। রাজস্ব খাতে সংস্কারের অন্যতম হলো আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং শুল্ক খাতে বছরের পর বছর যেসব করছাড় দেওয়া হয়েছে, সেগুলো কমানো।
এনবিআরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে আয়কর খাতে ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকার ছাড় দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ৮৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা এবং ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রায় সাড়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ৯৭টি খাতে করছাড় দেওয়া হয়। এসব ছাড় কীভাবে কমানো যায়, সেই কৌশল নির্ধারণে এবার আইএমএফ মিশনের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করবে এনবিআর।
আইএমএফ চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছর থেকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক-কর আদায়ের শর্ত দিয়ে রেখেছে। বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। আইএমএফ অবশ্য বলেছে, ৪ লাখ কোটি টাকা আদায় করলেই হবে। এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস জুলাই-ডিসেম্বরে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ২৩ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬৩০ কোটি আদায় হয়েছে।
আইএমএফের আরেকটি শর্ত হলো, আগামী ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেটের আগে ভ্যাট ও কাস্টমস শাখায় আলাদা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইউনিট স্থাপন করতে হবে। এই দুটি ইউনিট স্থাপিত হলেও পুরোদমে কাজ শুরু হয়নি।
রাজস্বসংক্রান্ত সংস্কার করার সময় নানা পক্ষ থেকে বাধা আসে। দীর্ঘদিনের অনৈতিক চর্চা বা অবৈধ লেনদেনের সুবিধাভোগীরাই প্রথমে বাধা দেন।
২০১২ সালের ভ্যাট আইন নিয়ে দু-তিন বছর ধরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা হয়। পরে ২০১৭ সালের জুলাইয়ে আইনটি চালুর প্রাক্কালে ব্যবসায়ীদের চাপে তা দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়। অথচ ভ্যাট আইনটি চালু করা আইএমএফের বর্ধিত সহায়তা তহবিলের (ইসিএফ) অর্থছাড়ের অন্যতম শর্ত ছিল। পরে ২০১৯ সালে একাধিক ভ্যাট হার করে আইনটি চালু করা হয়েছে।
কয়েক বছর আগে বাজেটে তৈরি পোশাক খাতে উৎসে কর দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। বিজিএমইএর তৎকালীন সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, সরকারের উচ্চ মহলে তদবির করে প্রস্তাবিত এই করহার তিনি কমিয়ে আনবেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তা করতে পেরেছিলেন।
এর আগে ১৯৯২ সালে আইএমএফের পরামর্শে ভ্যাট আইন চালু করতে গিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বিরোধী দলের পাশাপাশি নিজের দলেরও বিরোধিতার মুখে পড়েন।