আগুনে পুড়ে যাওয়ার পরে বঙ্গবাজারে এভাবেই অস্থায়ী দোকানে পণ্য বেচাকেনা চলছে। গত বছর নতুন করে বেচাকেনা শুরুর পরে ছবিটি তোলা হয়
আগুনে পুড়ে যাওয়ার পরে বঙ্গবাজারে এভাবেই অস্থায়ী দোকানে পণ্য বেচাকেনা চলছে। গত বছর নতুন করে বেচাকেনা শুরুর পরে ছবিটি তোলা হয়

অগ্নিকাণ্ডের এক বছর পর কেমন আছেন বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা

গত পবিত্র রমজান মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আগুনে পুড়েছিল বঙ্গবাজার। এরপর বছরজুড়ে নানা সমস্যার মধ্যে ঢাকার এই বাজারের পোশাক ব্যবসায়ীরা অস্থায়ী ভিত্তিতে ব্যবসা চালালেও এবারেও ঈদবাজার জমাতে পারেননি। বিশেষ করে পাইকারি বেচাকেনায় খুব একটা সুবিধা হয়নি। রোজার বাকি দিনগুলোয় খুচরা কিছু বেচাবিক্রি হবে—এমন আশা নিয়ে বসে আছেন তাঁরা। আগামী মাসের শুরুতে চাকরিজীবীদের হাতে টাকা এলে ভালো বিক্রি হবে বলে মনে করছেন বঙ্গবাজারের বিক্রেতারা।

গতকাল সোমবার বঙ্গবাজার ঘুরে দেখা গেছে, ঈদের বাজারের পোশাক বিকিকিনির পরিচিত সেই হাঁকডাক নেই। অথচ আগুনে পোড়ার আগের বছরগুলোয় ঈদের আগের এই সময়ে ব্যবসায়ীদের দম ফেলার সময় থাকত না। ব্যবসায়ীদের দাবি, গতবার এই সময়ে আগুনে পোড়ার পর থেকে বঙ্গবাজারে আর সেই আগের ব্যবসা ফিরে আসেনি। অনেক ক্রেতা বঙ্গবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অর্থনৈতিক মন্দাভাব, তাই ঢাকার বাইরে এবার পোশাকের চাহিদাও কম।

বঙ্গবাজার মহানগরী ইউনিটের দোকান আবদুর রহমান গার্মেন্টসের মনির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার ঈদবাজারে সব মিলিয়ে ৭ হাজারের মতো প্যান্ট বিক্রি করেছি। অন্য সময়ের ঈদের আগের তুলনায় যা তিন ভাগের এক ভাগ। তবে এরপরও স্বস্তির বিষয় ব্যবসাটা আস্তে ধীরে চালু করতে পেরেছি।’

মনির হোসেনের মতো অভিজ্ঞতা বঙ্গবাজারের প্রায় সব ব্যবসায়ীর। গত বছরের ৪ এপ্রিলের অগ্নিকাণ্ডের পর এক বছর ধরে তাঁরা ব্যবসায় টিকে থাকতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যতটা আশা করেছিলেন, পাইকারি ব্যবসা ততটা হয়নি। এখন তাকিয়ে আছেন খুচরা বিক্রির দিকে। তাঁদের ধারণা, আগামী মাসের শুরুতে চাকরিজীবীদের অনেকে মাসের বেতন ও ঈদের ভাতা হাতে পাওয়ার পরে বঙ্গবাজারে কেনাকাটা করতে আসবেন। আসবেন নিম্ন আয়ের মানুষও।

বঙ্গ ইসলামিয়া সুপার মার্কেটের মায়ের দোয়া গার্মেন্টসের স্বত্বাধিকারী নেয়ামাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতবার আগুনে পোড়ার আগেও যে কটা দিন ব্যবসা করতে পেরেছিলাম, তাতে দিনে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা বেচাকেনা ছিল। এখন দিনে ১০ হাজার টাকার কাপড় বিক্রি করতেও কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যদি খুচরায় বেচাকেনা বাড়ে, সেদিকে তাকিয়ে আছি। ঈদের আগে কিছু বেচাকেনা করতে পারলে টিকে থাকা সম্ভব হবে।’

বঙ্গবাজার অ্যানেস্কো টাওয়ারের নিচতলার ব্যবসায়ী সীমান্ত ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী আক্কাস আলীর কণ্ঠে নেয়ামাত হোসেনের কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল। আক্কাস আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেখতেই পাচ্ছেন বাজারে ক্রেতা নেই। অধিকাংশ ব্যবসায়ী অনেকটা অলস সময় পার করছেন। দিনে যেখানে লাখ টাকা বিক্রি হওয়ার কথা সেখানে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার বেচাকেনাকে ভালো বলা যাবে না। তবে গতবার তো আগুনের পর ব্যবসাই করতে পারিনি। সেই তুলনায় এখন ভালো আছি বলতে হবে।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি ইউনিটে (বঙ্গবাজার, গুলিস্তান, মহানগর ও আদর্শ) সব মিলিয়ে দোকান ছিল ২ হাজার ৯৬১টি। এ ছাড়া মহানগর শপিং কমপ্লেক্সে ৭৯১টি, বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটে ৫৯টি ও বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্সে ৩৪টি দোকান আগুনে পুড়েছে। সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৮৪৫টি দোকানের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

দক্ষিণ সিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বঙ্গবাজারে ক্ষতের পরিমাণ ছিল ৩০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে মালপত্রের ক্ষতি হয়েছে ২৮৮ কোটি টাকার বেশি। আর মার্কেটগুলোয় অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ ১৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এ ছাড়া দোকানের মালিক-কর্মচারীদের মানবিক ও মানসিক বিপর্যয়সহ ক্ষতির পরিমাণ এবং চাকরিহীনতার আর্থিক মাপকাঠি নিরূপণ করা দুরূহ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

তহবিলের টাকা বণ্টন হয়নি

বঙ্গবাজার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তার জন্য একটি উন্মুক্ত একটি তহবিল গঠন করা হয়েছিল। বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীসহ বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতিও এর নেতৃত্বে ছিল। আইএফআইসি ব্যাংকে একটি হিসাবও খোলা হয়। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশসহ অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ওই তহবিলে অনুদান দিয়েছিল। সব মিলিয়ে ৬ কোটি টাকার বেশি অর্থ সংগ্রহ হয়। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার এক বছর অতিবাহিত হতে চললেও সেই টাকা এখনো ব্যবসায়ীদের মধ্যে বণ্টন হয়নি।

এবার ঈদের আগে টাকা বণ্টনের জোর চেষ্টা চলছে উল্লেখ করে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা আশানুরূপ ব্যবসা করতে পারেননি। তবে আমরা নতুন মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগ বেশ এগিয়ে নিয়েছি। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য গঠিত তহবিলের ৬ কোটির বেশি টাকা আমাদের কাছে আছে। সরকারের থেকে আরও ১৫ কোটির টাকার মতো অনুদান পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ওই টাকাটা ঈদের আগে পেলে আমরা ব্যবসায়ীদের হাতে কিছু টাকা তুলে দিতে পারব বলে আশা করছি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, কিছু টাকা হাতে পেলে উপকার হতো। কিন্তু দিই দিই করেও তহবিলের টাকা বণ্টন করছেন না ব্যবসায়ী নেতারা। দ্রুত এই অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিলিবণ্টনের জন্য দাবি জানান তিনি।