সুদহারের সীমা তুলতে হবে, কমাতে হবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি

আইএমএফ থেকে গতকাল প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। অনুমোদনের তিন দিনের মাথায় তা পাওয়া গেল।

সুদের হারের সীমা তুলে নিতেই হবে। আর প্রতি অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব সংগ্রহ বাড়াতে হবে কমপক্ষে দশমিক ৫০ শতাংশ হারে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) যে সাড়ে তিন বছর ধরে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দেবে, সেই সময়ের মধ্যে রাজস্ব-জিডিপি বাড়াতে হবে ১ দশমিক ৭০ শতাংশ। শুধু তাই নয়, প্রতিবছর জিডিপির দশমিক ৫০ শতাংশ হারে রাজস্ব বৃদ্ধির নীতি অর্থ মন্ত্রণালয়কে গ্রহণ করতে হবে আগামী জুনের মধ্যে।

গত রাতে আইএমএফ এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে। সংস্থাটি আরও বলেছে, ঋণ কর্মসূচি চলাকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুশাসনব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, রাজস্ব স্বচ্ছতা আনা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ।

‘ঋণ অনুমোদনের পর প্রথম কিস্তি পেতে সময় লাগে না। ভালো হলো। এ সময়ে এ ডলারটার দরকার ছিল। এখন কাজ হচ্ছে পুরো কর্মসূচির শর্তগুলো পালন করা। যা দেখলাম, কঠিন কোনো শর্ত আইএমএফ দেয়নি। শর্তগুলো সহজ, এগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশ তথা দেশের মানুষের জন্য ভালো হবে।’
আহসান এইচ মনসুর, আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই)

এসব বহু শর্ত পূরণের শর্তে আইএমএফ যে গত সোমবার রাতে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে, গতকাল বৃহস্পতিবার তার প্রথম কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। প্রথম কিস্তির পরিমাণ ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার। ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের তিন দিনের মাথায় সংস্থাটি প্রথম কিস্তি ছাড় করল।

গতকাল বৃহস্পতিবার আইএমএফ প্রথম কিস্তি ছাড় করেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক। প্রথম আলোকে তিনি জানান, প্রথম কিস্তির অর্থ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যোগ হয়েছে। ১ ফেব্রুয়ারি বুধবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ২১৯ কোটি ডলার। আইএমএফের প্রথম কিস্তি পাওয়ায় তা বেড়ে ৩ হাজার ২৬৯ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে।

এদিকে ঋণের কিস্তি ছাড়ের দিনই পুরো কর্মসূচির শর্তগুলো উন্মুক্ত করেছে আইএমএফ। এতে বছরওয়ারি কোন সময়ে কী করতে হবে, তা বলে দেওয়া হয়েছে।

প্রথম কিস্তির পর বাকি ঋণ পাওয়া যাবে তিন বছরে অর্থাৎ ছয়টি সমান কিস্তিতে ৩৬ মাসে। দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়া যাবে এ বছরের ডিসেম্বরে আর শেষ কিস্তি পাওয়া যাবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে। এসব কিস্তির পরিমাণ ৭০ কোটি ৪০ লাখ ডলার করে।

ঠিক এক বছর আগে ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৪৯৯ কোটি ডলার। আর ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছিল।

ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের দিন আইএমএফ ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নিয়ে পূর্বাভাস দেয়। এতে রিজার্ভ সম্পর্কে বলা হয়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে দাঁড়াবে ৩ হাজার কোটি ডলার। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে বাড়বে এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছর শেষে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৫ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

আরও যেসব শর্ত মানতে হবে

এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারকে জ্বালানি পণ্যের সময়ভিত্তিক সূত্রসহ মূল্য সমন্বয়ের পদ্ধতি চালু করতে হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) মোট দেশজ উৎপাদনের তথ্য প্রকাশ করতে হবে তিন মাস পরপর, যা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়কে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এনবিআরের কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইউনিট চালু করতে হবে।

চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এমন নীতি নিতে হবে, যাতে ২০২৬ সালের মধ্যে জাতীয় বাজেটের অভ্যন্তরীণ অর্থায়নের এক–চতুর্থাংশ আসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে।

এ ঋণ কার্যক্রম চলাকালে ঋণের সুদহারের সীমা তুলে নিতে হবে। ইতিমধ্যে ভোক্তা ঋণের সুদহার বাড়ানোর কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা মোট ঋণের ১৪ শতাংশ। আর অন্য ঋণে সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ কত, তা জুনের হিসাবায়ন শুরু করতে হবে। এখন রিজার্ভ প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলার হলেও ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ আরও ৮ বিলিয়ন কম।

আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক যে দামে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে, তা জুনের মধ্যে বাজারের সমান হতে হবে। এখন ১০২ টাকা দামে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর ব্যাংকগুলোতে ডলারের দাম প্রায় ১০৬ টাকা। বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি হলে ডলারের দর একটিই (সিঙ্গেল রেট) করা হবে।

চলতি বছরের জুনের মধ্যে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থা শুরু করতে বলা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। ব্যাংক খাতের বিভিন্ন আইনেরও হালনাগাদ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রতিবছর ব্যাংকগুলোর খারাপ ঋণের তথ্য প্রকাশ করতে হবে।

আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণ অনুমোদনের পর প্রথম কিস্তি পেতে সময় লাগে না। ভালো হলো। এ সময়ে এ ডলারটার দরকার ছিল। এখন কাজ হচ্ছে পুরো কর্মসূচির শর্তগুলো পালন করা। যা দেখলাম, কঠিন কোনো শর্ত আইএমএফ দেয়নি। শর্তগুলো সহজ, এগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশ তথা দেশের মানুষের জন্য ভালো হবে।’