দুর্নীতি দারিদ্র্য সৃষ্টি করে, দক্ষতা নষ্ট করে, আস্থার সংকট বাড়ায় এবং বিনিয়োগের পরিবেশ ও সমাজকে শেষ করে দেয়।
ব্যবসায়িক সনদ নেওয়া থেকে শুরু করে আইনি সহায়তাসহ সব সরকারি সেবা পেতে অনৈতিকতার আশ্রয় নিতে হচ্ছে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতের ব্যবসায়ীদের। এসব ব্যবসায়ীকে সেবা পেতে ৭৮ শতাংশ ক্ষেত্রেই সরাসরি ঘুষ দিতে হয়। তাঁরা রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করেন ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে।
গতকাল রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত বেসরকারি খাত এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের দুর্নীতির সমস্যাবিষয়ক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ এবং ‘কল টু অ্যাকশন অ্যাগেইনস্ট করাপশন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এ তথ্য তুলে ধরা হয়।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিজিএসের গবেষণা সহযোগী আবদুল্লাহ আল জাফরী। তিনি বলেন, ৩৬ শতাংশ ক্ষেত্রে নতুন ব্যবসায়িক সনদ ও ৩১ শতাংশ ক্ষেত্রে সনদ নবায়নে দুর্নীতি হয়ে থাকে। ব্যাংকের ঋণ নিতে গেলেও অনেক ক্ষেত্রে ঘুষ দিতে হয়। এ ছাড়া সরকারের যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে কর ফাঁকি দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
অনুষ্ঠানে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে দুর্নীতির জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের অনিয়মের পাশাপাশি ব্যবসায়ী নেতাদের ভূমিকাও অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ। এসব নেতা ব্যবসায়ীদের কাছে জবাবদিহি করার পরিবর্তে মনোনয়নের মাধ্যমে পদে ক্ষমতাসীনদের অনুগত থাকেন বলেও মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘তত দিন পর্যন্ত অবস্থার কোনো পরিবর্তন আশা করতে পারি না, যত দিন না এসব প্রতিষ্ঠান একটি কাঠামোর মধ্যে জবাবদিহির আওতায় আসে।’ এ জন্য অবশ্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
ডিজিটাল ব্যবস্থা চালুর পর সরকারের কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি কমলেও সরকারি ক্রয়ব্যবস্থায় এখনো অনিয়ম হয় বলে মন্তব্য করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ জন্য তিনি সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণমূলক না হয়ে সমর্থনমূলক হওয়ার পরামর্শ দেন।
অনুষ্ঠানে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, যে দেশে অন্যায়ভাবে টাকা আয় করার পর তা ভোগের সুযোগ থাকে, সেখানে দুর্নীতি কমবে না। শক্তভাবে আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না। যাঁর কাছেই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, তিনি পারছেন না। কাজেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে এমন আলোচনা আরও হতে হবে। তবে আলোচনা করে থেমে থাকলে হবে না, বরং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, ব্যবসার সনদ নেওয়ার বিড়ম্বনা ছোট উদ্যোক্তাদের ছেড়ে কথা বলছে না। কারণ, যাঁরা এ সনদ দিয়ে থাকেন, তাঁরা সরকারি ফি ছাড়াও বাড়তি টাকা নেওয়ার মায়া ছাড়তে পারছেন না।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য ভ্যাট-ট্যাক্স একটা ভয়ের কারণ। তাঁদের রীতিমতো ধমকানো হয়। বলা হয়, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এসে তাঁদের ধরবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ দেশের অর্থনীতিতে এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান অনেক বেশি। তাদের বিপণনসহ নানা খাতে সুবিধা দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হবে।
পুরোনো গাড়ি ব্যাবসায়ীদের সংগঠন বারভিডার সাবেক সভাপতি আবদুল হক বলেন, ‘রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমূল সংস্কার করতে হবে। তাহলে হয়তো মানুষের মুক্তি আসবে। অন্যথায় দুর্নীতির সঙ্গে বাঁচার কৌশল শিখতে হবে।’
সিজিএসের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সংসদ সদস্য হাফিজ আহমদ মজুমদার, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, আমাদের নতুন সময়-এর সম্পাদক নাইমুল ইসলাম খান ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন ও সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।