দুই মাস ধরে শুল্ক-কর আদায় কমে গেছে। গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। সাধারণত অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে শুল্ক-কর আদায়ের গতি বাড়ে। কিন্তু এবার চিত্রটি উল্টো। মূলত ডলার–সংকটে পণ্য আমদানি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়ে। চলতি মাসেও শুল্ক-কর আদায়ে খুব বেশি গতি নেই।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে, অর্থাৎ জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি অন্য বছরের মতোই স্বাভাবিক ছিল। জুলাই মাসে ১৭ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা শুল্ক-কর আদায় হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে শুল্ক-কর আদায় বাড়তে বাড়তে নভেম্বরে গিয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় হয়। কিন্তু এরপরই বিপত্তি। জানুয়ারিতে শুল্ক-কর আদায় কমে ২৭ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসে। ফেব্রুয়ারিতে তা আরও কমে দাঁড়ায় ২৪ হাজার কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডলার–সংকট ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হওয়ায় গত ছয় মাসে এলসি খোলা বেশ কমেছে। এর প্রভাব আমরা অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে বেশি দেখতে পাব। কয়েক মাস ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশ স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। জিনিসপত্রের বেশি দামের কারণে সাধারণ মানুষ ভোগ কমিয়ে দিয়েছে, যা ভ্যাট আদায়ে প্রভাব ফেলছে।’
শুল্ক-কর আদায় কমে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো আমদানি কমে যাওয়া। ডলার–সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। গাড়ি, বিলাস পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ ব্যাংক নজরদারি বাড়িয়েছে, কঠিন করা হয়েছে শর্ত। সাধারণত গাড়ি ও বিলাস পণ্যেই সবচেয়ে বেশি শুল্ক-কর আদায় হয়। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় আমদানিকারকেরাও পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। গত বছরের মার্চ-এপ্রিলে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এর পর থেকেই দাম বাড়তে থাকে। ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে গত জুলাই মাসে ডলারের দাম ছিল ৯৫ টাকা। এখন তা বেড়ে ১০৫ টাকা হয়েছে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আমদানির ঋণপত্র খোলা কমেছে প্রায় এক-চতুর্থাংশ। ২০২১ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের তুলনায় ২০২২ সালের একই সময়ে ঋণপত্র খোলা কমেছে সাড়ে ২২ শতাংশের মতো। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৩ হাজার ৪১০ কোটি ডলারের। ২০২১ সালের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৪০১ কোটি ডলার। সেই হিসাবে, এক বছরের ব্যবধানে এক হাজার কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলা কমেছে। সবচেয়ে বেশি ঋণপত্র খোলা কমেছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে—প্রায় ৬৫ শতাংশ ঋণপত্র খোলা কমেছে। মধ্যবর্তী পণ্যে কমেছে ৩৩ শতাংশের মতো।
ডলার–সংকটে এলসি খোলা কমেছে সাড়ে ২২ শতাংশ
মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি কমেছে ৬৫ শতাংশ
৮ মাসে রাজস্বঘাটতি ২৩ হাজার কোটি টাকা
ঋণপত্র খোলা কমে যাওয়ায় শুল্ক-কর আদায়ও কমে যাচ্ছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় একদিকে যেমন আমদানি শুল্ক কমেছে, অন্যদিকে শিল্পের উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। নতুন শিল্প কারখানায় নতুন বিনিয়োগ কমে গেছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে একধরনের শ্লথগতি দেখা যাচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে ভ্যাট আদায়ে। আয়করেও এর প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছেন কর কর্মকর্তারা।
এনবিআরের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে জানান, গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে আমদানি শুল্ক ও আয়কর খাতে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় হয়নি। ভ্যাট আদায়ে কিছুটা গতি থাকলেও তা কত দিন ধরে রাখা যাবে, তা নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। এতে বছরের লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে।
রাজস্ব আদায় বাড়াতে এনবিআরের পক্ষ থেকে প্রতিটি কমিশনারেটকে আলাদা আলাদা মাসওয়ারি লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কমিশনারদের বকেয়া আদায় বাড়াতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মাঠপর্যায়ে তদারকি বাড়ানোর কথাও প্রতি মাসে রাজস্ব পর্যালোচনা বৈঠকে শুল্ক-কর কর্মকর্তাদের মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ইতিমধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পাওনা আদায়ে উদ্যোগী হয়েছে এনবিআর। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বকেয়া প্রায় চার হাজার কোটি টাকা আদায়ে আলোচনা চলছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি ২২ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। এনবিআরের প্রাথমিক হিসাবে, জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ১ লাখ ৯৬ হাজার ৩৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। এ সময়ে লক্ষ্য ছিল ২ লাখ ১৯ হাজার ১৫ কোটি টাকা আদায়ের।
চলতি অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য এনবিআরের। এ লক্ষ্য পূরণে গতবারের চেয়ে প্রায় ২৪ শতাংশ বেশি শুল্ক-কর আদায় করতে হবে। কিন্তু প্রথম আট মাসে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৯ শতাংশ। এ কারণে চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য কমিয়ে সাড়ে তিন লাখ করতে চায় এনবিআর। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় এখনো তাতে সায় দেয়নি।
এ বিষয়ে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘এনবিআরের রাজস্ব লক্ষ্য অর্জনে আমি আশাবাদী নই। বছর শেষে বড় ঘাটতি হবে। তাই শেষ পর্যন্ত বাজেট কাটছাঁট করতে হবে। বাধ্য হয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ কমাতে হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো বড় সংস্থাও এসব বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে রাজস্ব খাতে বড় সংস্কারের শর্ত দিয়েছে।’