জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বৈষম্য দূরীকরণ ও সংস্কারের বিষয়ে তথ্যের স্বচ্ছতা আনতে শ্বেতপত্র কমিটি গঠন করা হয়েছে। চোর ধরতে নয়, চুরির প্রক্রিয়া বুঝতে কাজ করছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি, যেন এরকমভাবে আগামী দিনে আর কোনো চুরি না হয়।
বুধবার বিকেলে সিলেটে দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রথম আঞ্চলিক মতবিনিময় সভায় এ কথা বলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। মতবিনিময় সভায় সিলেটের বিভিন্ন খাতের অংশীজনেরা নিজেদের মতামত তুলে ধরেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘বিগত সময়ে অনেক রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মচারী ব্যবসায়ী হয়ে গেছেন অথবা ব্যবসায়ীরাই রাজনীতিবিদ হচ্ছেন—এমনটাই আমরা জেনেছি। বর্তমান সরকার ও শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি এ অবস্থার পরিবর্তন কামনা করে। একই ধরনের নিপীড়ন ও ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে যেন আমরা না থাকি, সে পরিবর্তনটাই নতুন বাংলাদেশ চায়।’
গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নের যে বয়ান দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, গত দশক বা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নের বয়ান বাংলাদেশে প্রচলিত হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞ ও সমাজের বিভিন্ন খাতের বিশ্লেষকেরা এগুলো নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘আমরা বলেছি, এত উন্নয়ন হলো তবে কর আহরণ বাড়ল না কেন? করের টাকা গেল কই? এত উন্নয়ন হলো, তাহলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ হলো না কেন? আর বিনিয়োগ হয়ে থাকলে কর্মসংস্থান হলো না কেন? শুধু কর্মসংস্থানের জন্য এত লোক বিদেশে পাঠাতে হয় কেন? এতই যদি উন্নয়ন হয়ে থাকে, তাহলে অতি দারিদ্র্য কমল না কেন? বৈষম্য কমল না কেন?’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এসব চিন্তার মধ্যে একটা বড় বিষয় ছিল, যেসব তথ্য উপাত্ত সরকার দেয়, সেগুলো ঠিক কি না। বর্তমান সময়ের অন্যতম দুটি দাবি হলো বৈষম্য দূরীকরণ ও সংস্কার। এ দুটি বিষয় বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট তথ্যের স্বচ্ছতা দরকার। এ স্বচ্ছতা আনার জন্য আমাদের এই শ্বেতপত্র কমিটি গঠন হয়েছে।’
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির কাজ সম্পর্কে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘অনেকে প্রশ্ন করছেন, কালোটাকা কি সাদা করে দেবেন। আমরা বলছি, তা নয়। কিন্তু টাকা কেন কালো হয়, এটা বোঝা। অনেকে মনে করছেন, আমরা বোধহয় চোর–বাটপার ধরতে নেমেছি। কিন্তু বিষয়টা এমন নয়। আমরা চোর ধরতে নয়, চুরির প্রক্রিয়া বুঝতে নেমেছি। যাতে এরকমভাবে আগামী দিনে আর কোনো চুরি না হয়। এটি হলো আমাদের মূল কাজ। আর যেসব চুরিগুলো হয়েছে, সেগুলো কেমন করে হয়েছে, কী পরিমাণে হয়েছে, এর সম্ভাব্য ফলাফল কী, এই ফলাফল কে কীভাবে আটকানো যায়—এসব বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য আমরা কাজ করছি।’
সিলেটে শ্বেতপত্র কমিটির আঞ্চলিক সভার বিষয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এটা একটা জনশুনানি। এখানে আমরা শুনতে এসেছি, বাংলাদেশে যে এরকম একটা পরিস্থিতি হলো এর মূল কারণ আপনারা (সিলেটের বিভিন্ন খাতের অংশীজনেরা) কী দেখেন। আপনাদের এলাকার অর্থনৈতিক দুঃখ-কষ্ট চিহ্নিত করা যায় কীভাবে। আগামী দিনে এ দুঃখ–কষ্ট নিরসনে কী করা যায়। কারণ, এসব তথ্য চিহ্নিত করার মধ্য দিয়েই সংস্কারকাজ করা হবে।’
অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে চা, পর্যটন, মৎস্য, কৃষি, যোগাযোগ, প্রবাসী আয়সহ বিভিন্ন খাতের দুর্নীতি, অবহেলা ও উন্নয়ন–বঞ্চনা নিয়ে কথা বলেন সিলেটের অংশীজনেরা। তাঁরা বলেন, সিলেটে একের পর এক মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যার বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হয়নি। প্রকল্প মাঝপথে আটকে থাকলেও বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট করা হয়েছে। ফলে উন্নয়নবঞ্চিত থেকেছে সিলেট। বিভ্রান্ত পরিকল্পনা ও লুটপাটের কারণে হাইটেক পার্ক, অর্থনৈতিক অঞ্চল, পর্যটন প্রভৃতি বিষয়ে ব্যয় করা অর্থ মানুষের জীবনে কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি।
সভার শেষে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশে ভীতি ও আস্থাহীনতা এখনো বিদ্যমান। ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে কথা বলতে হবে। দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। এ ব্যাপারে সবার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। অর্থনৈতিক অবস্থার সংস্কারে এ ধরনের আলোচনা অব্যাহত রাখা হবে। সবার মতামত ও বাস্তবতা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই শ্বেতপত্র প্রণয়ন করা হবে।