এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রভাব নিয়ে গঠিত জাতীয় কমিটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার পর নানামুখী চ্যালেঞ্জে পড়বে বাংলাদেশ। বড় চ্যালেঞ্জ হবে রপ্তানি আয় কমে যাওয়া। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ২০২০ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর রপ্তানি আয় কমবে ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চ শুল্কে রপ্তানি করতে হবে বলে আয় কমতে পারে কমপক্ষে ৫১ হাজার কোটি টাকা।
তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর নতুন সম্ভাবনার দুয়ারও খুলতে পারে। যেমন এলডিসি থেকে উত্তরণ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে নতুন বার্তা দেবে। এতে বাংলাদেশের নতুন ভাবমূর্তি ও ব্র্যান্ডিং বাড়বে, যা বৈশ্বিক নীতিনির্ধারক ও বিনিয়োগকারীদের কাছে বিনিয়োগ আকর্ষণে ভূমিকা রাখবে।
এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি, পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও তদারক বিষয়ে ২০২১ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউসের নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটি গত মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তাতেই উঠে এসেছে চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি সম্ভাবনার দুয়ার খোলার কথা।
সময় এসেছে বাজারসুবিধানির্ভর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থেকে বেরিয়ে উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতাভিত্তিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতার দিকে যাওয়ার। আর অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।মোস্তাফিজুর রহমান, বিশেষ ফেলো, সিপিডি
এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ এত দিন বহির্বিশ্ব থেকে যেসব শুল্কসুবিধা পেয়ে আসছিল, ২০২৬ সালের পর সেগুলো অন্য সব এলডিসিভুক্ত দেশ বাংলাদেশের কাছে দাবি করবে। আবার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করতে গেলে ডব্লিউটিওর বিধিবিধান মানতে হয়। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশকে এত দিন তা কম মানলেও চলত। উন্নয়নশীল দেশ হয়ে যাওয়ামাত্রই বিধিবিধানগুলো পরিপূর্ণভাবে মানতে হবে। এসব নিয়ে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বাংলাদেশকে।
বিশেষ করে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে ওষুধশিল্প। আগে থেকেই বলা আছে, ২০৩৩ সালের আগে কোনো দেশ এলডিসি থেকে বের হলে ওষুধশিল্পের মেধাস্বত্ব–সুবিধা থাকবে না। বাংলাদেশ বের হচ্ছে তার সাত বছর আগে। আবার দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে ভারত ও চীন থেকে এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ ডব্লিউটিওর আওতায় যে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যসুবিধা পেয়ে আসছে, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এ সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোতে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত বাজারসুবিধা ভোগ করছে। সুবিধাটির সর্বোচ্চ ৯৬ শতাংশ ব্যবহার করছে বাংলাদেশ। ইইউ অবশ্য বলে দিয়েছে, ২০২৯ সাল পর্যন্ত সুবিধা বহাল রাখবে। এরপরই শুরু হবে মূল চ্যালেঞ্জ।
এলডিসি গ্রুপ ২০২০ সালে ডব্লিউটিওতে আবেদন করেছিল এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাজারসুবিধা যেন আরও ১২ বছর বহাল রাখা হয়। ২০২২ সালের জুনে অনুষ্ঠিত ডব্লিউটিও মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অবশ্য এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়নি। সেপ্টেম্বরে তা সংশোধন করে ছয় বছর চাওয়া হয়। সেটাও অনিশ্চিত।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় নিযুক্ত বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনকে এ ব্যাপারে লবি করতে বলা হয়েছে। জাতীয় কমিটির সুপারিশের মধ্যে আরও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, চীন ও ভারতকে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে রাজি করানো, যাতে তারা বাংলাদেশের প্রতি ইতিবাচক থাকে।
সম্ভাবনাময় বাণিজ্য অংশীদার জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভারত, ইউরেশীয় কাস্টমস ইউনিয়নের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করার জন্য যথাযথ সমীক্ষা ও কৌশলপত্র প্রণয়নেরও সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।
চ্যালেঞ্জের মধ্যে আরও রয়েছে—পণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা দেওয়া যাবে না। শুল্ক হারও যৌক্তিক করতে হবে। বিশ্ব কাস্টমস সংস্থা (ডব্লিওসিও) ও ডব্লিউটিওর বিধিবিধান মেনে বাংলাদেশকে সব ধরনের শুল্কহার নামিয়ে আনতে হবে যৌক্তিক পর্যায়ে। কাজটি এমনভাবে করতে হবে, যাতে দেশীয় শিল্পের স্বার্থ ক্ষুণ্ন না হয়। এ জন্য রাজস্ব আয় অনেক কমবে।
নগদ সহায়তা দেওয়ার সঙ্গে ডব্লিউটিওর তিনটি চুক্তি জড়িত। এগুলো হচ্ছে—ভর্তুকি ও পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থার ওপর চুক্তি (এএসসিএম), কৃষি ভর্তুকি এবং বাণিজ্য সম্পর্কিত বিনিয়োগ ব্যবস্থার ওপর চুক্তি (টিআরআইএমএস)। রপ্তানি বাণিজ্যকে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ বর্তমানে ৪৩টি পণ্যে রপ্তানি প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা দিচ্ছে। এএসসিএম চুক্তিতে বলা হয়েছে, এলডিসিভুক্ত দেশ নগদ সহায়তা দিতে পারবে। আর পণ্য উৎপাদনে আমদানি করা পণ্যের বিপরীতে দেশীয় পণ্য ব্যবহারের শর্ত আরোপ করে কোনো ভর্তুকি দেওয়া যাবে না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশ হয়ে গেলেই বাংলাদেশ রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা হারাবে এবং নগদ সহায়তা আর দিতে পারবে না।
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় দেশের কর সংগ্রহের পরিমাণ খুবই কম। প্রত্যক্ষ কর ও পরোক্ষ করের অনুপাত ৩৫: ৬৫। অতি দ্রুত তা ৭০: ৩০ করার কথা বলা হয়েছে। এ জন্য আয়কর ও মূসকের আওতা বাড়াতে হবে। করযোগ্য বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আয়কর ও মূসকের আওতায় আনতে হবে। বের করতে হবে করহার কমিয়ে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির কৌশল। সব মিলিয়ে দরকার এনবিআরের কাঠামোগত সংস্কার। আয়কর, মূসক ও শুল্কসংক্রান্ত যেসব বিধিবিধান ও পদ্ধতি আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, সেগুলো চিহ্নিত করে সংস্কার করতে হবে।
বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে এখন প্রত্যক্ষ করে মনোযোগ দিতে হবে। এ জন্য রাজস্ব প্রশাসনে ব্যবসাবান্ধব ও করদাতা সহায়ক প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে। আর সহজ করতে হবে পণ্য খালাস ও শুল্কায়ন প্রক্রিয়া। আমদানি শুল্ক থেকে বর্তমানে ৩৪ শতাংশ রাজস্ব আসে। তা চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরে ২৪ শতাংশ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২২ শতাংশ, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ২০ শতাংশ এবং এর পরের অর্থবছরে ১৮ শতাংশে নামিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবেদনে ভালো ভালো প্রস্তাব এসেছে। একটির সঙ্গেও দ্বিমত করার সুযোগ নেই। সংস্থা বা দপ্তরওয়ারি সময়বদ্ধ পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করাই এখন মূল বিষয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘রপ্তানি আয়ের কথা যদি বলি, সময় এসেছে বাজারসুবিধানির্ভর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থেকে বেরিয়ে উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতাভিত্তিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতার দিকে যাওয়ার। আর অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।’