বাংলাদেশ সরকারের ফিসক্যাল স্পেস কমে গেছে, অর্থাৎ রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির পথ নেই আর। সে কারণে সামাজিক নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি সম্ভব হচ্ছে না—অর্থনীতিবিদেরা হরহামেশাই এমন অভিযোগ করেন। সে কারণে অনেক ক্ষেত্রে সরকারকে কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি গ্রহণ করতে হয়। বিষয়টি হচ্ছে, সরকার কখনো কখনো নিজের অক্ষমতা থেকে এই নীতি গ্রহণ করে, আবার কখনো কখনো আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলোর চাপেও এ পথে পা বাড়ায়। যে কারণেই সরকার তা করুক না কেন, দেশে দেশে এই কৃচ্ছ্র নীতির পরিণাম হলো, প্রান্তিক মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি।
এদিকে চলতি বছর ডলারের বিনিময়মূল্য বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ সরকার ব্যালান্স অব পেমেন্ট সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের দ্বারস্থ হলো। তখন জ্বালানি তেলের ভর্তুকি প্রত্যাহারের শর্ত দেওয়া হয়। সরকার আগস্ট মাসে একলাফে সর্বোচ্চ ৫১ শতাংশ পর্যন্ত তেলের দাম বাড়িয়ে দেয়।
আইএমএফের ৪৫০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত পূরণে সারের পর তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। এতে মানুষের ভোগান্তি কতটা বেড়েছে, তা বলাই বাহুল্য। সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১০ শতাংশে উঠে যায়। এতে সরকারের ভর্তুকি কমেছে, কিন্তু বেড়েছে মানুষের ভোগান্তি।
বহুজাতিক সংস্থা অক্সফাম সম্প্রতি এই কৃচ্ছ্রসাধনের নীতির পরিণতি নিয়ে পুরোদস্তুর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘দ্য অ্যাসল্ট অব অস্টিয়ারিটি’ বা ‘কৃচ্ছ্রসাধনের নীতির অভিঘাত’। তাদের ভাষ্য, বিশ্বব্যাপী এই কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এই নীতি গ্রহণে বাধ্য করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের ভূমিকা আছে। তাদের কুখ্যাত কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি (এসএপি) একসময় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠেছিল। উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণের পরিমাণ একসময় অনেক বেশি ছিল, যেমন বাংলাদেশের উন্নয়ন বাজেটের ৮০ শতাংশের ওপর একসময় বিদেশি ঋণনির্ভর ছিল। এই কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল, আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী সংস্থাগুলোর ঋণ ফেরত পাওয়া নিশ্চিত করা। অক্সফামের প্রতিবেদনে এমন কথাই বলা হয়েছে।
তবে সেই দিন আর নেই। বাংলাদেশের উন্নয়ন বাজেটে বিদেশি ঋণের অনুপাত অনেকটাই কমে এসেছে। আফ্রিকার অনেক দেশও এখন ভালো করছে। এ ছাড়া ঋণদাতা হিসেবে চীনের আবির্ভাব সমীকরণ বদলে দিয়েছে। কিন্তু কৃচ্ছ্রসাধনের ভূত এখনো সারা বিশ্বকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এমনকি মহামারি ও যুদ্ধের সময়ও তা দেখা গেছে। অক্সফামের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কোভিড-১৯–জনিত সংকট মোকাবিলায় আইএমএফ ৮৫টি দেশকে বিভিন্ন কর্মসূচির নামে যে ১০৭টি ঋণ দিয়েছে, তার মধ্যে ৮৫ শতাংশ ঋণের শর্ত ছিল কৃচ্ছ্রসাধন। এরপর কোভিডের দ্বিতীয় বছরে অর্থাৎ ২০২১ সালে আইএমএফ যে ১৫টি ঋণ দিয়েছে তার শর্ত হিসেবেও কৃচ্ছ্রসাধনের নতুন শর্ত দেওয়া হয়েছে, যেমন খাদ্য ও জ্বালানিতে করারোপ বা ব্যয় হ্রাস, যার কারণে জরুরি সরকারি সেবা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোই নয়, অনেক উন্নত দেশও ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর থেকে কৃচ্ছ্সাধনের নীতির পথে হাঁটছে। প্রতিবেদনের ভাষ্য, এতে বিপর্যয় নেমে এসেছে, বিশেষ করে অরক্ষিত মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। মূলত ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি মোকাবিলা ও ঋণ পরিশোধে ইউরোপের ধনী দেশগুলো এই পথে হেঁটেছে। তার এক দশক পরের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যখন ইউরোপের মানুষের পরিবার ও শিশুদের জন্য ব্যয় বৃদ্ধি করা আবশ্যক ছিল, তখন সেটা তারা করতে পারেনি। সে সময় ইউরোপের কোনো দেশে পারিবারিক ব্যয় বাড়েনি, বরং দুই-তৃতীয়াংশ পরিবার মাথাপিছু আয় হ্রাস পেয়েছে। ইকুয়ালিটি অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস কমিশনের আরেক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যের কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারগুলোর আয় ৫ শতাংশ কমবে কেবল এই কৃচ্ছ্রসাধনের নীতির কারণে, যা একই সময়ে শ্বেতাঙ্গ পরিবারগুলোর আয় হ্রাস হারের দ্বিগুণ।
আর সামষ্টিক অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে, প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি বা আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলোর পরামর্শে ঋণ নিলে দেশগুলো একধরনের অসম ক্ষমতা সম্পর্কের খপ্পরে পড়ে। এতে অর্থনীতির হয়তো পুনরুদ্ধার হয়, কিন্তু তা দীর্ঘ মেয়াদে মানুষ ও জাতীয় সমৃদ্ধির জন্য আরও বড় ক্ষতির কারণ হয়।
আফ্রিকার দুর্দশা
আইএমএফের ঋণ নিয়ের আফ্রিকার দেশগুলোর কী বিপদ হয়েছে, তা একঝলক দেখে নেওয়া যাক। ২০২১ সালে কেনিয়াকে ২৩০ কোটি ডলার ঋণ দিতে রাজি হয় আইএমএফ। শর্ত হচ্ছে, দেশটির সরকারি ব্যয় তিন বছর বৃদ্ধি করা যাবে না এবং রান্নার গ্যাস ও খাবারে কর বৃদ্ধি করতে হবে। অথচ কেনিয়ার ৩০ লাখের বেশি মানুষ তীব্র ক্ষুধায় ভুগছে। সেই সঙ্গে চলছে তীব্র দাবদাহ, ফলে দেশজুড়ে তখন খরা চলছিল।
সুদানের প্রায় অর্ধেক মানুষ দরিদ্র। অথচ আইএমএফ চায়, দেশটির সরকার জ্বালানি খাতে ভর্তুকি তুলে নিক। এতে দেশটির সবচেয়ে দরিদ্র মানুষেরা আক্রান্ত হবে। সুদান তার প্রয়োজনের ৮৭ শতাংশ গম রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই দেশটির আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে আসছিল। ফলে তখন থেকেই দেশটিতে অর্থনৈতিক সংকট চলছিল। আর দেশটির ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষের এখন মানবিক সহায়তা প্রয়োজন এবং প্রায় ৯৮ লাখ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
এদিকে কেনিয়া, নামিবিয়াসহ আফ্রিকার ১০টি দেশ এখন সরকারি খাতের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি স্থগিত এবং কর্মসংস্থান সৃজন বন্ধ করবে। এর অর্থ হলো, শিক্ষার মান পড়ে যাওয়া এবং স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসক ও নার্স–সংকট, অথচ এসব দেশ এমনিতেই নানা ধরনের সংকটে জর্জরিত।
নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের বিপদ
নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধনের নীতির পরিণতি হলো, অধিকাংশ মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাওয়া। ৭৯টি নিম্ন আয়ের দেশের অসমতা ও দারিদ্র্যের সঙ্গে আইএমএফের কর্মসূচির সম্পর্ক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, যত বেশি কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি গ্রহণ করা হবে, তত বেশি অসমতা বৃদ্ধি পায়; সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পায় দারিদ্র্য।
কোভিডের সময় নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেক অর্থনীতিবিদই বলেছেন, মানুষের হাতে অর্থের সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন হলে নোট ছাপাতে হবে। উন্নত দেশগুলো এই পথেই কোভিড মোকাবিলা করেছে, যদিও উন্নয়নশীল ও নিম্ন আয়ের দেশগুলো তা পারেনি। সেসব দেশই যখন কোভিড ও যুদ্ধের জোড়া আঘাত সহ্য করতে না পেরে আইএমএফের ঋণের দ্বারস্থ হচ্ছে, তখন তাদের ওপর উল্টো কৃচ্ছ্রসাধনের শর্ত আরোপ করা হচ্ছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, এসব দেশের সরকারের এখন আরও বেশি করে জনকল্যাণে ব্যয় করা উচিত। কিন্তু আইএমএফের শর্ত দেখলে মনে হয়, তাদের লক্ষ্য শুধু নিজেদের ঋণ ফেরত পাওয়া নিশ্চিত করা; দরিদ্র বা নিম্ন আয়ের দেশগুলোর মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা নয়।