বিনায়ক সেন
বিনায়ক সেন

বাজেট যৌক্তিক ও বাস্তবোচিত 

এবারের বাজেটের বিশেষত্ব হচ্ছে, এতে রাজস্বনীতি, মুদ্রানীতি ও বাজারভিত্তিক সুদের হারের মধ্যে একটি সমন্বয় করা হয়েছে। নীতির মধ্যে সমন্বয় করার পদক্ষেপ আমার কাছে সঠিক মনে হয়েছে। এটি কঠিন কাজ। তবে এবারের বাজেটে সাহস করে সেটি করা হয়েছে। সামাজিক সুরক্ষার কর্মসূচি যাতে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর কাছে যায়, বাজেটে সেই চেষ্টাও হয়েছে। 

স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসির তালিকা থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে আসবে। এবারের বাজেটে সেটি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর বিভিন্ন ট্রেড ট্যাক্স বা বাণিজ্য শুল্ক আমরা অব্যাহত রাখতে পারব না। অভ্যন্তরীণ শিল্পকে এর জন্য এখন থেকেই প্রস্তুত করা হচ্ছে। আবার যেসব স্থানীয় শিল্পের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কম, এবারের বাজেটে তাদের সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। 

কৃষির মতো বেসিক পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আমদানির শুল্কহার একবারে কমানো হয়েছে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন যাতে বাড়ে, সে জন্য আরও বেশি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। সারের ভর্তুকি রাখা হয়েছে, কৃষি যান্ত্রিকীকরণে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে হবে সরবরাহ বাড়িয়ে। এবারের বাজেটকে কৃষি উৎপাদনমুখী করার চেষ্টা আছে।

তবে তিনটি বিষয় এড়ানো যায় বলে মনে হয়। প্রথমত, মুঠোফোনের টকটাইমের মতো সেবার ওপর শুল্ক বৃদ্ধি ও সিমের কর ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় বাড়ানোর কোনো দরকার নেই। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানোর দরকার নেই। এটা করা হয়েছিল ১৯৪৪ সালের সল্ট ট্যাক্স বা লবণ কর অনুসারে; বরং সম্পদ কর প্রবর্তন করা যেতে পারে। না হলে আমানতকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন। 

আর তৃতীয়ত, ১৫ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শন করার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তারও দরকার নেই; বরং এই অপ্রদর্শিত আয় আয়কর রিটার্নে দেখানোর সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এরপর নির্দিষ্ট হারে ওই অর্থের ওপর কর আদায় করা যেতে পারে। ৩৮ লাখ টাকার ওপরের আয়ে ৩০ শতাংশ কর দিতে হবে। অন্যদিকে অপ্রদর্শিত আয়ে কর ১৫ শতাংশ। এটা সমতার খেলাপ ও যুক্তিযুক্ত নয়।

আমার আরেকটি পরামর্শ হলো, সবার জন্য বেসরকারি স্বাস্থ্যবিমা চালু করা হোক, যাতে অসুস্থ হলে মানুষ বিমার সুবিধা নিতে পারে। এ জন্য বিমা কোম্পানিগুলোকে বেসরকারি স্বাস্থ্যবিমা-সংক্রান্ত সুবিধা চালু করতে বলা যেতে পারে।

আমি মনে করি, অর্থনীতির বর্তমান সমস্যা আগামী দু-তিন বছরে কেটে যাবে। ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হবে, তেলের দাম কমবে। মূল্যস্ফীতি গণনায় খাদ্যের অংশীদারি ৪৪ শতাংশ, বাকি ৫৬ শতাংশ আসে খাদ্যবহির্ভূত খাত থেকে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণ প্রোটিনের মূল্যবৃদ্ধি, আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হচ্ছে তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে। আমি মনে করি, বাজেটে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা যৌক্তিক খরচ। আমার কাছে বাস্তবোচিত মনে হয়েছে।

সামনে আগাতে দুটি ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে হবে। প্রথমত, খেলাপি ঋণের মতো সমস্যা সমাধানে ব্যাংক খাত সংস্কার করতে হবে। এর জন্য অন্তত একটি কমিটি করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, রাজস্ব খাতে সংস্কার করতে হবে। শহর এলাকার ১ কোটি ৩০ লাখ পরিবার ৪৫ শতাংশ আয়ের অধিকারী। এদের করজালে নিয়ে আসতে পারলে দরিদ্রদের ওপর করের বোঝা চাপাতে হয় না।


বিনায়ক সেন  মহাপরিচালক, বিআইডিএস