বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়েছে মুডিস

বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন উঁচু মাত্রার দুর্বলতা ও তারল্যের ঝুঁকি রয়েছে। একই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাও আছে।

মুডিস

আন্তর্জাতিক ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন উঁচু মাত্রার দুর্বলতা ও তারল্যের ঝুঁকি রয়েছে। একই সঙ্গে চলমান সংকটের মধ্যে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। এ কারণে মুডিস বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে বিএ৩ থেকে বি১-এ নামিয়েছে।

তবে বাংলাদেশের জন্য মুডিস তাদের পূর্বাভাস স্থিতিশীল রেখেছে। যদিও স্বল্পমেয়াদি ইস্যুয়ার রেটিংয়ের ক্ষেত্রে ‘নট প্রাইম’ বা শ্রেষ্ঠ গুণসম্পন্ন নয়, এমন মান অব্যাহত রাখার কথাও জানিয়েছে তারা।

মুডিস বলেছে, পরিস্থিতি খানিকটা সহজ হলেও বাংলাদেশে ডলার-সংকট চলমান এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত কমে যাচ্ছে, যা এ দেশের বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতির ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। সেই সঙ্গে আমদানির ক্ষেত্রে নানা ধরনের বাধা তৈরি হয়েছে। যার ফলাফল হিসেবে জ্বালানির ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

‘মুডিস ঋণমান কমানোর ফলে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ ও ঋণের সুদের হার বাড়বে।’ তিনি একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, সুদের হার যদি আধা শতাংশও বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় সাত হাজার কোটি থেকে আট হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়।
আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই

এ বিষয়ে মতামত চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুডিস ঋণমান কমানোর ফলে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ ও ঋণের সুদের হার বাড়বে।’ তিনি একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, সুদের হার যদি আধা শতাংশও বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় সাত হাজার কোটি থেকে আট হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগও বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ, খরচ বেশি হলে বিদেশিরা এ দেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন না।

এর আগে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর মুডিস বলেছিল, দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের ঋণমান বিএ৩ ও ‘সিনিয়র আনসিকিউরড রেটিংস’-এর মানের বিষয়টি পুনর্মূল্যায়ন করবে। সেই পুনর্মূল্যায়নের অংশ হিসেবে ঋণমান কমানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি গতকাল মঙ্গলবার এ তথ্য প্রকাশ করেছে।

মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ইন্টিগ্রেটেড রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট ফার্ম বা সমন্বিত ঝুঁকি মূল্যায়ন ও ঋণমান নির্ণয়কারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। এটি ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে ঝুঁকি মূল্যায়ন ও ঋণমান নির্ণয়ের কাজ করে আসছে। বর্তমানে বিশ্বের ৪০টির বেশি দেশে ১৩ হাজারের অধিক জনবল নিয়ে বিস্তৃত রয়েছে তাদের কার্যক্রম।

সরকারের বিদ্যমান ঋণের ক্ষেত্রে এর প্রভাব খুব বেশি হবে না। কারণ, সরকার নির্দিষ্ট (ফিক্সড) সুদেই বেশির ভাগ ঋণ করেছে। এ ধরনের ঋণমানের প্রভাব বাণিজ্যিক ঋণের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়।
নাসের এজাজ বিজয়, ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই)

বাংলাদেশের ঋণমান পুনর্মূল্যায়নের কারণ হিসেবে মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস অর্থনীতির বহিঃস্থ খাতের দুর্বলতা বৃদ্ধি ও ধারাবাহিক তারল্যঝুঁকির কথা উল্লেখ করেছে। সেই সঙ্গে চলমান সংকটের পরিস্থিতিতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার যে চিত্র উঠে এসেছে, তার সঙ্গে ঋণমান অবনমনের সিদ্ধান্ত প্রাসঙ্গিক বলে মনে করে প্রতিষ্ঠানটি।

মুডিস বলেছে, সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিল, তা পুরোপুরি প্রত্যাহার করেনি। সেই সঙ্গে ডলারের একাধিক বিনিময় হার চালু ও সুদের হার ঠিক করে দেওয়ার মতো অপ্রচলিত যেসব ব্যবস্থা রয়েছে, সেখান থেকেও বাংলাদেশ ফিরে আসেনি। এ ধরনের অপ্রচলিত পদক্ষেপ বিভিন্ন ধরনের বিকৃতি ঘটাচ্ছে, মানে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।

এ ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় কম রাজস্ব আদায়ের কারণে সরকারের পছন্দসই নীতি গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে নিজস্ব মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন ও স্বল্প সময়ে অভ্যন্তরীণ ঋণের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার ফলে সুদ বাবদ সরকারকে আরও বেশি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। এটি সরকারের ঋণ গ্রহণের সক্ষমতাকে দুর্বল করার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ঋণমান কমানোর প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি নাসের এজাজ বিজয় গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের বিদ্যমান ঋণের ক্ষেত্রে এর প্রভাব খুব বেশি হবে না। কারণ, সরকার নির্দিষ্ট (ফিক্সড) সুদেই বেশির ভাগ ঋণ করেছে। এ ধরনের ঋণমানের প্রভাব বাণিজ্যিক ঋণের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়।

নাসের এজাজ আরও বলেন, ‘বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। কারণ, আমাদের দেশে এমনিতেই বিদেশি বিনিয়োগ জিডিপির তুলনায় কম। বিনিয়োগের আগে বিনিয়োগকারীরা ঋণমানের পাশাপাশি বিনিয়োগ পরিবেশের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। সেখানে আমরা উন্নতি করতে পারলে ঋণমানের নেতিবাচক প্রভাব কাটাতে পারব।’

এদিকে মুডিস আশা করছে, বিদেশি অর্থায়ন বৈদেশিক ও রাজস্বসংক্রান্ত চাপ কিছুটা কমাতে সাহায্য করবে। তবে মহামারির আগের তুলনায় বৈদেশিক পরিস্থিতি দুর্বল থাকবে এবং উঁচু মাত্রার ঋণের কারণে রাজস্ব আদায়ে দুর্বলতা দেখা যাবে। মুডিস মনে করে, রাজস্ব খাতের সংস্কারে যেসব কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়িত হতে অনেক বছর লেগে যাবে।

প্রতিষ্ঠানটির মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বড় হলেও রাজস্ব আদায় সামঞ্জস্যহীনভাবে কম হওয়ায় সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ কম। সে জন্য সরকারের ঋণ নেওয়ার সক্ষমতাও কম। এ ক্ষেত্রে কারণ হিসেবে মুডিস দেশীয় ঋণের স্বল্প মেয়াদ ও ডলারের বিপরীতে স্থানীয় টাকার বিনিময় হার কমার কথা বলেছে। যদিও মুডিস আশা করছে, বিদেশি ঋণ পাওয়ার কারণে বাংলাদেশের বহিঃস্থ অর্থনীতির ওপর চাপ কমবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে দেওয়া পূর্বাভাস স্থিতিশীল রাখার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে মুডিস বলেছে, দেশটি কম সুদে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অর্থায়ন ও সহায়তা পেয়ে আসছে। ফলে বৈদেশিক ও রাজস্ব খাতে চাপ হালকা হতে পারে।

মুডিস মনে করে, বাংলাদেশের ঋণভার একই রকম, মানে অন্যান্য দেশের তুলনায় মাঝারি পর্যায়ে রয়েছে এবং কম সুদে দীর্ঘ সময়ের জন্য ঋণ নেওয়ার কারণে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে।