আজ ৩০ এপ্রিল। ঠিক দুই বছর আগে ৮৮ বছরের বর্ণাঢ্য ও বর্ণিল পার্থিব জীবন শেষ করে পরপারে পাড়ি জমান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম কারিগর আবুল মাল আবদুল মুহিত। আমৃত্যু তিনি সৃষ্টিশীল সুকুমারবৃত্তির চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। ভাষাসৈনিক, আমলা, কূটনৈতিক, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, উন্নয়নবিশেষজ্ঞ, রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, পরিবেশবিদ, লেখক, গবেষক বহু অভিধায় তাঁকে অভিহিত করা যায়। তাঁর মতো এমন সাদামনের মহানুভব ব্যক্তি আজকের দিনে খুব বিরল। তাঁর শিশুসুলভ সরল হাসি যে কারও মন জয় করে নিতে পারত।
এককালের ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের যে মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ, তার অন্যতম কুশীলব ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশ্বমন্দায় পৃথিবীজুড়ে অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থায় তিনি ২০০৯ সালে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। টানা ১০ বছর দায়িত্ব পালন শেষে বিদায়কালে বাংলাদেশকে রেখে গেছেন বিশ্ব অর্থনীতির এক মর্যাদাকর অবস্থানে। তাঁর ১০ বছরের মন্ত্রিত্বকালে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার বেড়েছে চার গুণ। প্রবৃদ্ধির হার ছাড়িয়েছে ৮ শতাংশ। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়। এ ছাড়া ২০১৮ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের জন্য নির্ণায়ক তিনটি সূচকের নির্ধারিত সীমা অর্জনে সক্ষম হয়। সূচক তিনটি হচ্ছে মাথাপিছু জাতীয় আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচক।
মুহিত স্যারের কর্মের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল চলমান গতানুগতিকতার বাইরে কাজ করা। বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে মিল রেখে চলতে পছন্দ করতেন তিনি। তাঁর সময়েই ২০০৯-১০ অর্থবছরে অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) খাতে প্রথমবারের বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়। বাংলাদেশে জেলা বাজেটের প্রবক্তাও তিনি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে টাঙ্গাইল জেলাকে দিয়ে দেশে জেলা বাজেটের প্রচলন শুরু হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো চালু করেন শিশু বাজেট। তিনি ছিলেন বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার অন্যতম উদ্যোক্তা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তিনি এ বিষয়ে কাজ শুরু করেন। সে সময় এ বিষয়ে একটি অবস্থানপত্রও তৈরি করা হয়েছিল। পৃথিবীর অন্যতম দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী হয়েও চলনে-বলনে ছিলেন অতি বিনয়ী ও মার্জিত।
‘আলোকিত সিলেট’ দর্শন নিয়ে ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হয়ে সিলেট-১ আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। সিলেট নগরীর উপশহর এলাকায় এক নির্বাচনী জনসভায় স্যারকে প্রথম সামনাসামনি দেখি। আমি তখন সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। গতানুগতিক রাজনৈতিক বক্তব্যের বাইরে গিয়ে তিনি সাবলীলভাবে বর্ণনা করেন তাঁর নির্বাচনী দর্শন ‘আলোকিত সিলেট’। প্রতিপক্ষকে দোষারোপ আর নিজ দলের গুণকীর্তনে ভরপুর জ্বালাময়ী বক্তব্য শুনতে অভ্যস্ত অনেকের কাছে স্যারের সেদিনকার বক্তব্য আকর্ষণীয় না হলেও তিনি যে নতুন কিছু করার চিন্তা নিয়ে রাজনীতির মাঠে নেমেছেন, তা বুঝতে ভুল করিনি। অবশ্য নিজের প্রথম নির্বাচনে তিনি সফল হতে পারেননি। চারদলীয় জোট প্রার্থী সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের কাছে পরাজিত হন। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাইফুর রহমানকে হারিয়ে তিনি প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। দশম সংসদ নির্বাচনেও তিনি সিলেট-১ আসন থেকে পুনরায় নির্বাচিত হন।
২৮তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০১০ সালে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে যোগদান করলে তাঁর অধীনে কাজ করার সুযোগ হয়। দেশের হয়ে অর্থনৈতিক কূটনীতির দায়িত্ব পালনই অর্থ বিভাগের মূল কাজ। নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য নিয়মিত মন্ত্রী বরাবর নথি উপস্থাপন করতে হতো। নথি অনুমোদন অথবা ফেরত পাঠানোর মধ্যেই তিনি সীমাবদ্ধ ছিলেন না। নোটে উত্থাপিত কোনো ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ তাঁর কাছে যথার্থ মনে হলে তাতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে অভিবাদন জানিয়ে উৎসাহব্যঞ্জক নানা মন্তব্য লিখে দিতেন। আবার কোনো প্রস্তাব কিংবা ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলে তা লিখে দিতেন এবং কীভাবে সংশোধন, বিয়োজন কিংবা সংযোজন করতে হবে, তার নির্দেশনাও নথিতে উল্লেখ থাকত। স্বয়ংসম্পূর্ণ নথিতে ধন্যবাদজ্ঞাপন মন্তব্য লিখলেও কোনো তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি সমন্বিত কিংবা ভিন্নমত পোষণ করা নথিতে কখনো ভর্ৎসনামূলক কোনো মন্তব্য করেননি। বরং সেই বিষয়টি কীভাবে জুতসই করে উপস্থাপন করতে হবে, সে নির্দেশনা দিতেন। সরকারি চাকরির তিন মাসের মাথায় নথিতে তাঁর নিজের হাতে লিখিত অভিবাদন পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। একেবারে শিক্ষানবিশ অবস্থায় তাঁর মতো প্রাজ্ঞজনের কাছ থেকে এমন অনুপ্রেরণামূলক মন্তব্য নিঃসন্দেহে আমার কর্মস্পৃহাকেই অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। পরে বেশ কয়েকবার তাঁর এমন লিখিত অভিবাদন পেয়েছিলাম।
যুক্তরাজ্য থেকে উচ্চতর শিক্ষা শেষে ২০১৫ সালের অক্টোবরে অর্থ বিভাগে যোগদান করে স্যারের আরও কাছাকাছি কাজ করার এবং কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাই। বাজেট অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে যে বক্তব্য উপস্থাপন করেন, কৌশলগত কারণে বাজেট পেশের আগের রাতেই তা চূড়ান্ত করা হয়। মধ্যরাতে বাজেট বক্তব্যের খসড়া মুদ্রণের পর তিনি পুরোটা পড়ে চূড়ান্ত অনুমোদন দিতেন। এতে অনেক সময় গভীর রাত হয়ে গেলেও তাঁর মধ্যে কোনো ক্লান্তি বোধ দেখিনি। পরদিন সকালে ঠিকই মন্ত্রিসভায় উপস্থিত হয়ে প্রস্তাবিত বাজেটের নীতিগত অনুমোদন নিয়ে দুপুরে দীর্ঘ বাজেট বক্তব্য সংসদে পেশ করতেন।
বাজেটে দলিলের অন্যতম অনুষঙ্গ ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা’ ও ‘বাংলাদেশ ইকোনমিক রিভিউ’। প্রতিটি বই প্রায় সাড়ে তিন শ পৃষ্ঠার হয়ে থাকে। মুদ্রণের জন্য ছাপাখানায় পাঠানোর আগে মন্ত্রীর অনুমোদন নিতে হয়। বাজেট উপলক্ষে মহা ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি যে পুরো বইটি পড়েছেন, তা নথিসংশ্লিষ্ট শাখায় ফিরে আসার পর বুঝতে পারতাম। কেননা অতিগুরুত্বপূর্ণ সব পৃষ্ঠা, অনুচ্ছেদ, সারণি কিংবা লেখচিত্রে কখনো কাঠপেনসিল আবার কখনো কলম দিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের চিহ্ন পাওয়া যেত। একবার এমনও হয়েছে ব্যস্ততার কারণে পুরো পাণ্ডুলিপি পড়তে পারেননি বলে বিদেশ যাওয়ার প্রাক্কালে বিমানবন্দরে বসে পুরোটা পড়ে অনুমোদন প্রদান করেন।
স্যার নিজের কাজ নিজেই করতে পছন্দ করতেন। সাধারণত নিজের দৈনন্দিন কর্মসূচি নিজ হাতেই তৈরি করে তাঁর দপ্তরসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং অন্যদের মধ্য বিতরণ করতেন। তাঁর অফিসকক্ষে একাধিকবার স্বচক্ষে এই দৃশ্য দেখেছি। কাজ করতে গিয়ে স্যারের প্রখর স্মৃতি শক্তির প্রমাণ পেয়েছি বহুবার। ২০১৭ সালে অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্যোগে আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার স্মৃতিচারণা করেন। ১৯৪৭ সালে সিলেটে অনুষ্ঠিত গণভোটের প্রচারণার উদ্দেশ্যে আয়োজিত এক জনসভায় প্রথমবারের মতো সে সময়কার তরুণ প্রতিভাবান ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বচক্ষে দেখার বিস্তারিত বর্ণনা করেন। ৭০ বছর আগের ঘটনা অথচ তাঁর স্মৃতিচারণা এত প্রাণবন্ত ছিল যে মনে হয়েছে যেন কিছুদিন আগের কাহিনি। কয়েক দশক আগের ঘটনাবলি দিন, তারিখ সময়সহ তিনি স্পষ্টভাবে বলতে পারতেন। তা শুনে মনে হতো যেন কয়েক দিন আগের কোনো ঘটনা।
সিলেট শহরে অনুষ্ঠিত আমার বিয়ের অনুষ্ঠানে স্যারকে দাওয়াত করেছিলাম। পূর্বনির্ধারিত সূচি পর্যালোচনায় জানা গেল, একই দিনে তাঁর সিলেট সফর আছে। দিন, তারিখ মিলে যাওয়ায় স্বভাবসুলভ সেই সরল হাসি দিয়ে বললেন, ‘অনেক দিন বিয়ে খাওয়া হয় না। আমি যাব।’ জানিয়েছিলেন জুমার নামাজ শেষ করেই আসবেন। শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থতা সত্ত্বেও ঠিক সময়েই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সরকারি অনুষ্ঠানের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানেও তাঁর সময়ানুবর্তিতার কোনো হেরফের হয়নি।
স্যারের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল ২০২০ সালে, তাঁর জন্মদিনে। জন্মদিন উপলক্ষে তাঁকে নিয়ে প্রথম শ্রেণির একটি জাতীয় দৈনিকে লিখেছিলাম। লেখাটি পড়ে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন না লিখে এখন কেন লিখলাম। তাঁর মন্ত্রিত্বকালে লিখলে কেউ কেউ মনে করতেন বাড়তি বলছি, আবার কারও ধারণা হতো কোনো বিশেষ সুযোগ নেওয়ার জন্য হয়তো লিখছি। তাই অবসর সময়েই লিখেছি—এই জবাবে খুব সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। এরপর, মাঠ প্রশাসনে চলে আসায় তাঁর সঙ্গে আর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি।
মুহিত স্যার আজ আমাদের মাঝে নেই সত্যি। তবে তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মে। আগামী প্রজন্ম তাঁকে খুঁজে পাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে, বদলে যাওয়া বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আর তাঁর সুলিখিত অর্ধশতাধিক গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে।
লেখক: মো. মিনহাজুল ইসলাম জায়েদ, উপসচিব, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়, কক্সবাজার।