গত তিন বছরে সরকার যেভাবে বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে তাতে বাংলাদেশ ‘ঋণখেলাপি’ নয় বলে যে গল্পটি ছিল, সেটি এখন বদলে যেতে শুরু করেছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ৬ বিলিয়ন বা ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের বিদেশি দায় পরিশোধ করতে পারছে না। ঋণখেলাপি হওয়া আর জিনিসপত্র এনে দেনা শোধ করতে না পারার মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে কী পার্থক্য, এটাই এখন বড় বিবেচ্য বিষয় হয়ে সামনে এসেছে। দায়দেনা পরিশোধ করতে না পারায় বাংলাদেশ একধরনের খেলাপি হয়ে গেছে। ফলে আমরা খেলাপি নই, আগের সেই গল্প আর থাকছে না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) চার দিনব্যাপী বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলনের তৃতীয় দিনে আজ সোমবার একটি অধিবেশনে সভাপতির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। এই অধিবেশনের আলোচ্য বিষয় ছিল, ‘সরকারের দেশি-বিদেশি ঋণ: কত এবং কতটা বেশি’। এতে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সরকারের দেশি-বিদেশি দায়দেনা পরিস্থিতি তুলে ধরেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কানাডার কনকোডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মঈনুল আহসান। রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে বিআইডিএসের বার্ষিক সম্মেলন চলছে।
মূল প্রবন্ধে সৈয়দ মঈনুল আহসান বলেন, ঋণ করে যদি স্বাস্থ্য ও মানবসম্পদের উন্নয়নে ব্যবহার করা হয়, তাহলে সেটিকে বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সরকারের দেশি–বিদেশি ঋণ গ্রহণের সক্ষমতা নির্ভর করে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতির ওপর। তা ছাড়া ঋণ নিয়ে তা কোথায় বিনিয়োগ করা হচ্ছে এবং সেই বিনিয়োগ থেকে কী পরিমাণ রিটার্ন পাওয়া যাচ্ছে, সেটিও বিবেচ্য বিষয়। বাংলাদেশের কর–জিডিপির অনুপাত খুব বেশি নয়। তাই জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আদায় বাড়াতে না পারলে ঋণের চক্রে পড়তে হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, একসময় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঋণের চেয়ে বিদেশি ঋণ বেশি ছিল। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি বদলে গেছে। তাই কর আদায়ের মাধ্যমে সরকার যে অর্থ সংগ্রহ করছে তা থেকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে অর্থের জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। রাজস্ব উদ্বৃত্ত বলে কিছু থাকছে না। তাই নতুন করে ঋণ করতে হচ্ছে। যার প্রভাব সুদের হার ও ব্যক্তি বিনিয়োগের ওপর পড়ছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমাদের হিসাবে প্রায় প্রতিবছর সরকারের বিদেশি দায়দেনা ১০০ কোটি ডলার করে বাড়তে চলেছে। কয়েক বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের বাড়তি চাপ তৈরি হবে। তাই এখন সময় এসেছে সরকারের মধ্য থেকে যাঁরা আমরা খুব ভালো আছি বলে সরকারকে ঋণ গ্রহণে উৎসাহিত করেছিলেন, তাঁদের খুঁজে বের করার। তাঁদের খুঁজে বের করে এনে জানতে হবে, তাঁরা সরকারকে এ রকম একটি ভুল পথে নিয়ে গিয়েছিলেন নাকি সরকার তাঁদের এই ধরনের ভ্রান্ত হিসাব তৈরিতে বাধ্য করেছিল, তা জানার।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের নতুন করে আর ঋণ নেওয়ার পরিস্থিতি আছে কি নেই, তা খতিয়ে দেখতে হবে। যদি নতুন করে ঋণ নেওয়ার পরিস্থিতি না থাকে, তাহলে সরকারের উচিত হবে ঋণদাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে নতুন করে সমঝোতা করা। সেখানে ঋণ পরিশোধ পিছিয়ে দেওয়া ও শর্ত শিথিল করাসহ সুদের হার, গ্রেস পিরিয়ড এসব বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। ঋণ নিয়ে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে, সেগুলো চালু হওয়ার আগেই কিস্তির সময় হয়ে গেছে। এখন কিস্তি পরিশোধের সময় বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
সরকারের দেশি–বিদেশি ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠিত এই কর্ম–অধিবেশনের আগে মধ্যহ্নভোজ–পরবর্তী পাঁচটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয় সম্মেলনে। এর মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে বিআইডিএসের গবেষক তাহরিন তাহমিনা চৌধুরী, আয়বৈষম্য নিয়ে আজরিন করিম, শহর ও গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতায়নের ক্ষেত্রে সামষ্টিক অর্থনৈতিক কারণ নিয়ে মুনতাসির মোর্শেদ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ১৯৭০ সালে ভোলা সাইক্লোন নিয়ে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহমেদ মুশফিক মোবারক।