দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য

ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য, বাস্তবতা কতটুকু  

বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে গত মাসে মৌখিক আলোচনা করলেও ভারত এখন আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেবে। 

ভারতীয় রুপি
ফাইল ছবি: রয়টার্স

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে মার্কিন ডলারের পরিবর্তে রুপি ব্যবহারের প্রস্তাব তৈরি করছে ভারত। দেশটি শিগগির এ-বিষয়ক আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠাবে বাংলাদেশ সরকারকে। প্রস্তাব পাওয়ার পর অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে মিলে বিভিন্ন বিষয় যাচাই-বাছাই করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। 

ভারতের দিল্লিতে গত মাসের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত দুই দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে রুপি ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়া হলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাদের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলা হয়। সেই প্রস্তাবই এখন তৈরি করছে ভারত।

দিল্লি থেকে বৈঠক করে এসে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত কিছু বলতে পারিনি। বলেছি আলোচনা হতে পারে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ৮ হাজার ৯১৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয় ভারত থেকে। সেই অর্থ বছরে বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করে ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য। আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে উভয় দেশের মধ্যে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। 

ভারতের রিজার্ভের সমস্যা নেই। ১২ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর ক্ষমতা আছে দেশটির। বড় অর্থনীতির দেশের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে ঝুঁকির বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে আমাদের। 
মোস্তাফিজুর রহমান, বিশেষ ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)

কোভিড-১৯-এর ধাক্কার পাশাপাশি প্রায় এক বছর ধরে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যুদ্ধের কারণে দেশে ডলারের দাম অনেক বেড়ে গেছে। সংকটও তৈরি হয়েছে ডলারের। আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেছে জিনিসপত্রের দাম। তাতে আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। ফলে ডলার-সংকট আরও প্রকট হয়। এমন পরিস্থিতিতে কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা বা নিজস্ব মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে ভারত। ডলার বা অন্য কোনো হার্ড কারেন্সিকে এড়িয়ে দুটি দেশ যখন নিজেদের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য চালায়, সেটিকে আর্থিক পরিভাষায় ‘কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা’ বলা হয়।

জানা গেছে, রাশিয়া, মরিশাস, ইরান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারত রুপিতে বাণিজ্যও শুরু করেছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতীয় মুদ্রায় আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য বাণিজ্য সংগঠন ও ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দিতে থাকে দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে ১৯৬০-এর দশকে কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান—এসব দেশ ভারতীয় রুপি গ্রহণ করত। পরে তা বন্ধ হয়ে যায়।

গত মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান। গত বৃহস্পতিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অপেক্ষায় আছি ভারত কী প্রস্তাব দেয়। তারপর আমরা এ নিয়ে বিশ্লেষণের পথে যাব।’

ভারতের সামনে উদাহরণ রাশিয়া

ইউক্রেন আক্রমণের পর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে রাশিয়া। তখন বিকল্প পথ বের করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পুতিন ঘোষণা করেন, ইউরোপের দেশগুলো যদি রাশিয়া থেকে গ্যাস নিতে চায়, তাহলে ইউরো বা ডলার দিলে হবে না, দিতে হবে রাশিয়ার মুদ্রা রুবল। পুতিনের কাছে হিসাব ছিল পরিষ্কার। সেটা হচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো ৪০ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে রাশিয়া থেকে। এ দাওয়াই কাজে দেয় এবং রুবলের মান বাড়তে থাকে। 

ভারতীয় রুপির মান বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের ডলার-সংকটের এ সময়ে ভারতও বাংলাদেশকে একই ধরনের প্রস্তাব দিয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের মতে, ভারতীয় কিছু পণ্যের ওপর বাংলাদেশ যে অনেকটাই নির্ভরশীল, তা ভারত জানে। ফলে ভারত একটা সুযোগ
নিতে চাইছে। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ইতিমধ্যে ভারতীয় মুদ্রায় আন্তর্জাতিক লেনদেন করার আইনি বাধা দূর করেছে। ভারত সরকার চায় আন্তর্জাতিক বাজারে রুপির কদর বাড়াতে। 

জানা যায়, ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্যের উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত। ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির মান তখন পড়ছিল। পরে অবশ্য সেই উদ্যোগ সফল হয়নি।

বাংলাদেশ নিট পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ব্যবধান অনেক বেশি। ফলে ভারতের প্রস্তাব তত্ত্বগতভাবে ঠিক হলেও বাস্তবে কঠিন। হতে পারে ভারত
থেকে ২০০ কোটি ডলারের যে রপ্তানি আয় বাংলাদেশ করে, সে পরিমাণ বাণিজ্য ভারতীয় মুদ্রায় করার কথা ভাবা হচ্ছে। সেটি হলেও এক হাজার কোটি ডলারের বেশি যে আমদানি ব্যয়, তা ডলারেই করতে হবে।’

রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে ভারতীয় রুপিতে বাণিজ্য শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কী সমস্যা—এমন প্রশ্নের জবাবে ফজলুল হক বলেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের মৌলিক পার্থক্য আছে। এ উদ্যোগ যদি কার্যকরও হয়, ডলার-সংকট মেটাতে তা কতটা সাহায্য করবে, সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান।’

এত রুপি আসবে কোথা থেকে

ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্যের বিষয়টি নিয়ে যখন আলোচনায়, তখন কিছু প্রশ্নও সামনে চলে এসেছে। সেগুলো হচ্ছে ভারত যে রুপিতে বাণিজ্যের প্রস্তাব দিয়েছে, বাংলাদেশ এত রুপি পাবে কোথায়? ডলারকে রুপিতে পরিবর্তন করে তারপর রুপিতে আমদানি করলে তাতে কোনো লাভ হবে কি? ভারতের স্বার্থটা কী, আর বাংলাদেশই-বা কেন এতে রাজি হবে?

ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য করেন, এমন একজন ব্যবসায়ী জানান, আরেকটি উপায় হতে পারে ভারতের ব্যাংক থেকে রুপি ঋণ করে আমদানি ব্যয় মেটানো। সে ক্ষেত্রে আছে সুদ ব্যয়ের বোঝা। আর ভারত যে যখন-তখন বাংলাদেশি মুদ্রার বিপরীতে রুপির দর বাড়িয়ে দেবে না, তারও-বা নিশ্চয়তা কী? 

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘২০০ কোটি ডলার রপ্তানির সমপরিমাণ ভারতীয় রুপিতে বাণিজ্য হতে পারে। তবে এর সঙ্গে বিনিময় হারসহ অনেক বিষয় জড়িত। বাংলাদেশি টাকা এখন না হয় একটু অবমূল্যায়িত, ভবিষ্যতে এ পরিস্থিতি না-ও থাকতে পারে। ভারতের রিজার্ভের সমস্যা নেই। ১২ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর ক্ষমতা আছে দেশটির। তবে একটি বড় অর্থনীতির দেশের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে ঝুঁকির বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে আমাদের।’