মালিকেরা বলছেন, আনুষঙ্গিক খরচ ও শ্রমিকের মজুরি বাড়ানোয় চায়ের উৎপাদন খরচ বেড়েছে, তবে সেই অনুযায়ী বাড়তি দাম মিলছে না।
মজুরি বৃদ্ধি ও আনুষঙ্গিক খরচ বাড়ায় চায়ের উৎপাদন খরচ বেড়েছে, কিন্তু গত কয়েকটি নিলামে চায়ের দাম কিছুটা বাড়লেও এখনো চায়ের গড় দাম গত বছরের তুলনায় কম। এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত চলতি বছরের ১৮টি চায়ের নিলামের গড় দাম তুলনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এসব নিলামে গত বছরের তুলনায় গড়ে চায়ের দাম কম পেয়েছেন বাগানমালিকেরা।
চার-পাঁচ বছর আগেও নিলামে চায়ের গড় দাম ছিল প্রতি কেজি ২০০ টাকার বেশি। ২০১৭-১৮ নিলাম মৌসুমে গড়ে প্রতি কেজি চা বিক্রি হয় ২১৪ টাকা। পরের বছর তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২৬৩ টাকা। কিন্তু চলতি মৌসুমে চায়ের গড় দাম প্রতি কেজি ২০০ টাকার নিচে। অথচ এ সময়ে চা উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাস ও কয়লার দাম বেড়েছে; আনুষঙ্গিক খরচও বেড়েছে। এরপর প্যাকেটজাত চায়ের দাম বাড়লেও শুধু নিলামে দামে বাড়েনি।
জীবনযাপনের খরচ বেড়ে যাওয়ায় গত মাসে চা–শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন চা-শ্রমিকেরা। গত ৯ আগস্ট থেকে দুই ঘণ্টা কর্মবিরতি এবং ১৩ আগস্ট থেকে সারা দেশের চা-বাগানগুলোয় অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট পালন করেন শ্রমিকেরা। এ পরিস্থিতিতে ২৭ আগস্ট চা-বাগানমালিকদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠক করেন। বৈঠকে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি বাড়িয়ে ১৭০ টাকা করার বিষয়ে সম্মত হন বাগানমালিকেরা। এরপর ধর্মঘট প্রত্যাহার করে কাজে যোগ দেন চা-শ্রমিকেরা।
শ্রমিকদের আন্দোলন শুরুর আগে গত জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে চট্টগ্রামের নিলামে চায়ের গড়মূল্য ছিল প্রতি কেজি ২১২ টাকা ৮৪ পয়সা। আগস্টের শেষ সপ্তাহের নিলামে কেজিপ্রতি চায়ের দাম সাড়ে ১০ টাকা বেড়ে ২২৩ টাকা ৪৪ পয়সায় উন্নীত হয়েছে। এক মাসের ব্যবধানে নিলামে চায়ের বাড়তি দাম পাওয়া গেলেও এখনো গড় দাম কম বলে নিলামের তথ্যে দেখা যায়।
গত এপ্রিলে চট্টগ্রাম ও সিলেটের নিলামকেন্দ্রে চায়ের নিলাম শুরু হয়। নিলামে চা বেচাকেনায় মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ব্রোকার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রামের ১৮টি নিলামে ৩ কোটি ২৭ লাখ কেজি চা বিক্রি হয়েছে, যার গড়মূল্য ছিল ১৯৯ টাকা ৫৬ পয়সা। এর আগে ২০২১-২২ মৌসুমে একই সময়ে ৩ কোটি ২৯ লাখ কেজি চা বিক্রি হয়েছে, যেখানে প্রতি কেজি চায়ের গড় দাম ছিল ২০০ টাকা ৮০ পয়সা। সেই হিসাবে চলতি মৌসুমে নিলামে কেজিপ্রতি চা গত বছরের তুলনায় প্রায় সোয়া এক টাকা কমে বিক্রি হয়েছে।
চা-বাগানমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, নিলামে প্রত্যাশিত দাম না পেলে এই শিল্প চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। বাগানের উন্নয়ন ও শ্রমিককল্যাণ নিশ্চিত করতে নিলামে চায়ের ভালো দাম দরকার। পাশাপাশি এই শিল্পের কল্যাণে সরকারের সহযোগিতাও দরকার। শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতাও বাড়াতে হবে।
মজুরি বাড়ানোর পর উৎপাদন খরচ কত বেড়েছে, তার সঠিক হিসাব এখনো জানাতে পারেননি বাগানমালিকেরা। মালিকদের দাবি, এবার গড় উৎপাদন খরচ ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তবে মজুরি বাড়ানোর পর কয়েক মাসের উৎপাদনের পরিসংখ্যান দেখে প্রকৃত চিত্র জানা সম্ভব।
এ বছর এখন পর্যন্ত দেশে চায়ের উৎপাদন গত বছরের তুলনায় বেশি। চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই পর্যন্ত ৭ মাসে দেশে চা উৎপাদিত হয়েছে ৩ কোটি ৮৩ লাখ টন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ৫ লাখ কেজি বা ১ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি।
তবে বাগানমালিকেরা বলেন, ধর্মঘটের কারণে পাতা উত্তোলন না করায় চা উৎপাদনের ভরা মৌসুম আগস্ট মাসে উৎপাদন কমবে। উৎপাদনে প্রভাব পড়বে সেপ্টেম্বর মাসেও। সে ক্ষেত্রে বছর শেষে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে, যদিও চা বোর্ড এ বছর ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। আবার উৎপাদন কমলে চায়ের উৎপাদন খরচও আরেক দফা বাড়তে পারে।
বিদ্যমান বিপণনব্যবস্থা অনুযায়ী, বাগানের উৎপাদিত চা নিলামে বিক্রি করতে হয়। নিলাম থেকে চা কিনে সরকারকে কর পরিশোধের পর সেই চা বাজারজাত করা হয়ে থাকে। তবে উৎপাদকেরা চাইলে চা বোর্ডের অনুমতি নিয়ে নিজেদের বাগান থেকে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ চা সংগ্রহ করতে পারেন।
নিলামে অংশগ্রহণকারীরা জানান, নিলামে দাম কত হবে, তা নির্ভর করে চায়ের মান এবং বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর। করোনার প্রভাব হ্রাসের পর থেকে চায়ের চাহিদা বাড়তির দিকে। শীত মৌসুমে চায়ের চাহিদা আরও বাড়বে। তাই নিলামে ভালো দাম উঠতে পারে বলে আশা করছেন বাগানমালিকেরা।