আগামীকাল মঙ্গলবার একনেকে উঠছে রেকর্ড ৫০ প্রকল্প। বর্তমান সরকারের মেয়াদে শেষ এই সভাকে সুযোগ হিসেবে দেখছেন প্রভাবশালীরা।
বর্তমান সরকারের মেয়াদের একেবারে শেষ সময়ে মন্ত্রী, এমপি ও আমলাদের নিজের এলাকায় প্রকল্প পাস করিয়ে নেওয়ার তোড়জোড় চলছে। আগামীকাল মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এটিই হতে পারে বর্তমান সরকারের মেয়াদে শেষ একনেক সভা। তাই প্রভাবশালীরা একে দেখছেন শেষ সুযোগ হিসেবে। তাঁদের চাপ সামলাতেই এ সপ্তাহের একনেকে ৫০টি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য উঠছে। এক একনেক সভায় এত প্রকল্প এর আগে ওঠেনি।
এসব প্রকল্পের একটি হলো পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলমের নিজের এলাকায় জন্য সেতু নির্মাণ প্রকল্প। চাঁদপুরের মেঘনা-ধনাগোদা নদীর ওপর একটি ঝুলন্ত সেতু নির্মাণের প্রস্তাব উঠছে একনেকে। তা ছাড়া একনেকে যাচ্ছে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের এলাকায় দেড় কিলোমিটার সেতু নির্মাণের প্রকল্প। সারা দেশের সংসদ সদস্যদের নির্বাচনী এলাকায় পছন্দমতো রাস্তাঘাট নির্মাণের প্রকল্পের মেয়াদ ও খরচ বাড়ানোর প্রস্তাবও উপস্থাপিত হতে পারে বৈঠকে। পাশাপাশি ভোটের আগে জনতুষ্টির বেশ কিছু রাস্তাঘাট নির্মাণের প্রকল্পও একনেকে উঠছে।
সামনে নির্বাচন। ভোটের বাজারে বাড়তি সুবিধা পেতে নিজ নিজ এলাকায় প্রকল্প পাস করানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন এমপি-মন্ত্রীরা। সরকারকে ঘিরেও একধরনের অনিশ্চয়তা আছে। প্রভাবশালীরা পছন্দের প্রকল্প পাস করিয়ে অন্তত এডিপি অন্তর্ভুক্ত করে রাখতে চাচ্ছেনমুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, সাবেক সচিব ও বড় অকাঠামো বিশেষজ্ঞ
এ বিষয়ে সাবেক সচিব ও বড় অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সামনে নির্বাচন। তাই ভোটের বাজারে বাড়তি সুবিধা পেতে নিজ নিজ এলাকায় প্রকল্প পাস করানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন এমপি-মন্ত্রীরা। এ ছাড়া সরকারকে ঘিরে একধরনের অনিশ্চয়তা আছে। তাই প্রভাবশালীরা নিজেদের পছন্দের প্রকল্প পাস করিয়ে অন্তত এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করে রাখতে চাইছেন। তাই মন্ত্রী, এমপি, আমলাদের পছন্দের প্রকল্প প্রস্তাব বেশি জমা পড়ছে।’
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান আরও বলেন, সরকারের শেষ সময়ে আগের চেয়ে বেশি প্রকল্প পাস হচ্ছে। কিন্তু অর্থনীতির এই সংকটের সময়ে প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত টাকা সরকারের হাতে নেই।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এখনো ৪০টির বেশি প্রকল্প প্রস্তাব চূড়ান্ত করার পর্যায়ে আছে। তাই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় আরও একটি একনেক সভা করতে আগ্রহী।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেনের গ্রামের বাড়ি বরিশালের মুলাদি উপজেলার পাতারচর এলাকায়। বরিশাল সদরে যেতে মুলাদি-বাবুগঞ্জ-রহমতপুর সড়ক ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু এই সড়কের মীরগঞ্জ এলাকায় আড়িয়াল খাঁ নদ পার হতে হয় ফেরিতে। মীরগঞ্জে প্রায় দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি সেতু নির্মাণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের প্রস্তাব একনেকে উঠছে।
এসব প্রকল্পের একটি হলো পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলমের নিজের এলাকায় জন্য সেতু নির্মাণ প্রকল্প। চাঁদপুরের মেঘনা-ধনাগোদা নদীর ওপর একটি ঝুলন্ত সেতু নির্মাণের প্রস্তাব উঠছে একনেকে। তা ছাড়া একনেকে যাচ্ছে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের এলাকায় দেড় কিলোমিটার সেতু নির্মাণের প্রকল্প।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, সেতু নির্মাণের প্রকল্প প্রস্তাবটি একনেকে ওঠাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছেন। এই প্রকল্পে খরচ হবে ১ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। প্রকল্প চলবে ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। সাধারণত প্রকল্পের মেয়াদ একনেকে পাস করার আগে থেকে শুরু হয়। তবে এই প্রকল্প পাস হয়ে থাকবে, পরে কাজ শুরু হবে। পুরোপুরি দেশীয় অর্থে সড়ক ও জনপথ বিভাগ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বর্তমান সরকারের টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী। তবে তিনি নিয়মিত তাঁর নির্বাচনী এলাকা চাঁদপুরের মতলবে যান। বর্তমান সরকারের মেয়াদের শেষ সময়ে তিনি এলাকাবাসীর জন্য সেতু উপহার দিতে চান। এ জন্য ৪ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া ও চাঁদপুরের মতলবের মেঘনা-ধনাগোদা নদীর ওপর ঝুলন্ত সেতু নির্মিত হবে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, সেতু নির্মাণের প্রকল্প প্রস্তাবটি একনেকে ওঠাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছেন। এই প্রকল্পে খরচ হবে ১ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। প্রকল্প চলবে ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত।
বর্তমানে দাউদকান্দি সেতু পার হয়ে দাউদকান্দি-শ্রেয়ারচর বাজার-মতলব হয়ে চাঁদপুর যাওয়ার রাস্তাটি তুলনামূলকভাবে কম দূরত্বের। ইতিমধ্যে দাউদকান্দি থেকে শ্রেয়ারচর বাজার পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত করার কাজ চলছে। তাই এখন গজারিয়া হয়ে নতুন সেতু নির্মাণ করে আলাদা সড়কপথ করার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
তবে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেতু নির্মাণ সব সময়ই ভালো। অর্থনৈতিক বিবেচনায় সেতু কখনো অলাভজনক নয়। এতে মানুষ উপকৃত হয়। যদি রাস্তা না থাকে, সেতু করা হয়—তাহলে তা ক্ষতিকর। সবকিছু বিবেচনা করেই সেতু নির্মাণের ওই প্রকল্প দুটি একনেক পাঠানো হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, প্রকল্প পাস করানোর জন্য মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আমলাদের চাপ নেই। তবে নিজেদের এলাকায় প্রকল্প পাস করাতে জনপ্রতিনিধিদের আগ্রহ থাকে।
প্রতিবছর সংসদ সদস্যরা নিজ এলাকায় ইচ্ছেমতো রাস্তাঘাট, সেতু-কালভার্ট নির্মাণে ৫ কোটি টাকা খরচ করতে পারেন। বর্তমান সরকার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় এসে চার বছর মেয়াদি এ–সংক্রান্ত প্রকল্প নিয়েছিল। এখন চলছে প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়। কিন্তু নির্বাচনের ঠিক আগে এসে এই পর্যায়ের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পল্লি অবকাঠামো উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পটির তৃতীয় পর্যায় শুরু হয় ২০২০ সালের জুলাই মাসে। এটি শেষ হওয়ার কথা ২০২৪ সালের জুন মাসে।
সেতু নির্মাণ সব সময়ই ভালো। অর্থনৈতিক বিবেচনায় সেতু কখনো অলাভজনক নয়। এতে মানুষ উপকৃত হয়। যদি রাস্তা না থাকে, সেতু করা হয়—তাহলে তা ক্ষতিকর। সবকিছু বিবেচনা করেই সেতু নির্মাণের ওই প্রকল্প দুটি একনেক পাঠানো হয়েছে।পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত তিন বছরের কাঙ্ক্ষিত হারে অর্থ খরচ হয়নি। এ ছাড়া নির্বাচনের বছরে এমপিরা নিজ নিজ এলাকায় নতুন নতুন রাস্তাঘাট, সেতু-কালভার্ট নির্মাণের প্রস্তাব পাঠাচ্ছেন। প্রকল্প প্রস্তাব ঘেঁটে দেখা গেছে, নতুন করে ৩৯২ কিলোমিটার সড়ক এবং ২ হাজার ৬৪ মিটার সেতু-কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্পে যুক্ত হচ্ছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের সংশোধিত প্রস্তাবে খরচ ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। গত আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রকল্পে খরচ হয়েছে ২ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাস্তবায়নের অগ্রগতি ৪১ শতাংশ। আগামী মঙ্গলবারের একনেকের তালিকায় এই প্রকল্প না থাকলেও শেষ মুহূর্তে টেবিলে উপস্থাপিত হতে পারে।
মঙ্গলবারের একনেকে রেকর্ড ৫০টি প্রকল্প উঠছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বেশ কয়েকজন এমপি নিজ নিজ এলাকায় প্রকল্প পাসের জন্য সুপারিশ করেছেন। বেশির ভাগই রাস্তাঘাট, সেতু-কালভার্ট নির্মাণের প্রকল্প। তালিকায় দেখা গেছে, সিলেট, নওগাঁ, মাগুরা ও জয়পুরহাটের গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে চারটি প্রকল্প আছে। ভবন ও অবকাঠামো নির্মাণের প্রকল্পের মধ্যে আছে ঢাকার অফিসার্স ক্লাবে বহুতল ভবন, শেরেবাংলা নগরে সরকারি অফিসের ভবন, মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র স্থাপন, সরকারি কর্মকমিশন সচিবালয়ের সাতটি আঞ্চলিক কার্যালয়, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী এলাকার পানিসুবিধা বৃদ্ধি ও ১০ জেলায় বিএসটিআই আঞ্চলিক কার্যালয় নির্মাণ। যোগাযোগ খাতের প্রকল্পগুলোর মধ্যে আছে ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার বিদ্যমান সড়ক উন্নয়ন, ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে জমি অধিগ্রহণ ও চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেলপথ দ্বৈত গেজে রূপান্তর করা।
একনেক সভা ছাড়াই পরিকল্পনামন্ত্রী ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচের প্রকল্প নিজে অনুমোদন দিতে পারেন। তবে তা একনেকে অবহিত করতে হয়। পরিকল্পনামন্ত্রীর সম্প্রতি অনুমোদন করা এমন প্রায় ৩২টি প্রকল্পও মঙ্গলবারের একনেকে যাচ্ছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এখনো ৪০টির বেশি প্রকল্প প্রস্তাব চূড়ান্ত করার পর্যায়ে আছে। তাই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় আরও একটি একনেক সভা করতে আগ্রহী।