সরকার গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, স্বেচ্ছাচারী রাজনীতি জন্ম দিয়েছে অনাচার অর্থনীতির। অবশ্য তিনি বলেন, এ দুটি পরস্পরের পরিপূরক। তবে প্রশ্ন করা যায়, স্বৈরাচারী বা স্বেচ্ছাচারী রাজনীতি অনাচার অর্থনীতিকে জন্ম দিয়েছে, নাকি উল্টোটা ঘটেছে। অর্থাৎ অনাচার অর্থনীতি স্বেচ্ছাচারী রাজনীতি তৈরি করেছে।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি দেখছে যে বিগত সরকারের সময় চারটি খাতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে। যেমন ব্যাংক, জ্বালানি, সরকারি প্রকল্প এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাত। অন্যান্য খাতেও দুর্নীতি হয়েছে, তবে এই চার খাতের সঙ্গে তুলনীয় নয়।
আজ বৃহস্পতিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এক সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ কথা বলেন। অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সদস্যদের সঙ্গে এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় অংশ নেন কমিটির সদস্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মি, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম, সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, অধ্যাপক এ কে এনামুল হক, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ, অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান এবং কমিটিকে সহায়তা প্রদানকারী সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে ইআরএফ সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ এবং সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেমসহ অন্য সদস্যরা মতবিনিময় সভায় অংশ নেন।
শুরুতেই দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘পুরোনো ভ্রান্তি থেকে আগামী দিনের পথ খুঁজতে চাচ্ছি। এ বিষয়ে কমিটি ৯০ দিনের মধ্যেই প্রতিবেদন জমা দেবে। তবে এখানে কোনো ব্যক্তি নিয়ে নয়, বরং প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।’ তিনি আরও জানান, শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ৫টি জায়গায় মূলত কাজ করছে। যেমন অর্থনৈতিক অনাচার মেরামত করতে কোন কোন খাতে সংস্কার প্রয়োজন, তা বলা হবে। চারটি খাতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হওয়ার কথা উল্লেখ করেন। কাজের দ্বিতীয় ক্ষেত্র হচ্ছে এ রকম এক পরিস্থিতিতে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা কী হবে, তা বিশ্লেষণ করা। কেননা অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা স্থগিত করা হয়েছে। তৃতীয়ত, শ্বেতপত্র কমিটি স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কী কী করণীয়, তারও একটি রূপরেখার কথা বলবে। এরপরের বিষয় হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের ঘাটতিগুলো কীভাবে পূরণ করা যায়। এখানে তথ্য-উপাত্তের বিশ্বাসযোগ্যতা একটি বড় বিষয়। এই তথ্য-উপাত্ত নিয়েও সন্দেহ–সংশয় আছে অনেক দিন ধরে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা নিজেদের অসহায়ত্ব ও সরকারের হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন।
শ্বেতপত্র কমিটির আরেকটি কাজ হবে স্বল্প মেয়াদে অর্থনীতিতে স্থিতি আনার জন্য কী কী করা যায়, সে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা। এর মধ্যে আছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, টাকার মূল্যমান, আর্থিক ঘাটতি, ঋণের দায় পরিশোধ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতি, সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিকঠাক করা ইত্যাদি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসহ বিগত সরকারের নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্প অতিমূল্যায়িত ছিল, আবার সেখান থেকে চুরি হয়েছে, কাজ দেওয়ার সময় করা হয়েছে স্বজনপ্রীতি। রাজনৈতিক সম্পর্ক যাদের ছিল, তারা এসব প্রকল্পের কাজ পেয়েছে। আর সব সিদ্ধান্ত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে, যেহেতু সাবেক প্রধানমন্ত্রী নিজেই জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বিভাগের মন্ত্রী ছিলেন।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জনগণের করের টাকায় বড় বড় প্রকল্প হয়েছে। কিন্তু এসব প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা কেউ কখনো চোখে দেখেনি। অথচ এসব বড় প্রকল্পের ঋণের দায় পরবর্তী প্রজন্মের ওপর চাপানো হয়েছে। সে সময় অর্থের অবৈধ প্রবাহও অনেক বেড়ে গিয়েছিল। শুরুতে এসব অর্থ অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে ব্যবহার হলেও শেষের দিকে পাচার হয়েছে বেশি।
অধ্যাপক এ কে এনামুল হক বলেন, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইইডি) যে প্রকল্পে অর্থের ব্যবহার নিয়ে একেবারেই ভালো কিছু প্রতিবেদন দেয়নি তা নয়, কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অনেক অডিট আপত্তির রিপোর্ট দেওয়া হলেও তা নিয়ে দুদক কিছু করেনি। দেখা গেছে, ২০১৮ সালের দিকে দুদকে অনেক অভিযোগ জমা হতো, কিন্তু ২০২২ সালে তা অনেক কমে গেল। কারণ, সাধারণ মানুষের আস্থা ছিল না।
ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা নীতির ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। আর তাঁদের বড় অনুযোগ এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর।
অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, এনবিআর অনেক ধরনের উদ্যোগ নিলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। আর এনবিআর এখন বলছে, তাদের ওপর অর্থ মন্ত্রণালয় লক্ষ্যমাত্রা চাপিয়ে দিত, নিজেরা কিছু জানত না।
সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম বলেন, সরকার যেভাবে উন্নয়নের বয়ান তৈরি করেছিল, তথ্য-উপাত্ত সেভাবে তৈরি করা হয়েছে।
অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মি স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের নানা অব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেন।
জাহিদ হোসেন বলেন, তথ্য–উপাত্ত নিয়ে একদিকে যেমন পদ্ধতিগত সমস্যা আছে, অন্যদিকে সরকারের হস্তক্ষেপ ঘটেছে। তথ্য-উপাত্ত সাজানোর প্রবণতা অনেক বেশি দেখা গিয়েছিল। তিনি বলেন, এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে সরকারের ভেতর জবাবদিহির জায়গাটা কীভাবে তৈরি করা যাবে। বর্তমানে সংস্কারের আলোচনা চলছে। তবে জবাবদিহির ব্যবস্থা কী হবে, তা শেষ বিচারে ঠিক করে দেবে রাজনীতি।
সেলিম রায়হান বলেন, প্রতিষ্ঠান দুই ধরনের, একটি রাজনৈতিক, অন্যটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান। দুই জায়গাতেই বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে। মোটা দাগে সমস্যাটি শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের অসম্ভব ত্রুটিযুক্ত নির্বাচনের পর থেকে। যেকোনো সরকারের টিকে থাকার জন্য তার রাজনৈতিক বৈধতা দরকার। সেই রাজনৈতিক বৈধতার সংকট শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে। আর তখন থেকেই উন্নয়নের বয়ানটা আরও শক্তিশালীভাবে শুনতে পাওয়া গেছে। সেই উন্নয়নের বৈধতা দেওয়ার চেষ্টার মধ্যেই দেখা দিল ক্রনি ক্যাপিটালিজমের বড় রকমের উল্লম্ফন।
এ সময় দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, তিনি ক্রনি ক্যাপিটালিজমের বাংলা করেছেন, ‘চামচা পুঁজিবাদ’।
সেলিম রায়হান এ বিষয়ে বলেন: প্রকল্পনির্ভর যে দুর্নীতি, তারও বড় উল্লম্ফন হয়েছে গত এক দশকে। তখন দেখা গেছে মুষ্টিমেয় একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় নীতি থেকে লাভবান হচ্ছে। তাদের সঙ্গে ছিলেন ক্ষমতাসীন রাজনীতির কেন্দ্রে থাকা অভিজাতেরা, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সামরিক-বেসামরিক আমলাদের একটি অংশ। এরা মিলে যে একটা গোষ্ঠী তৈরি করেছে, তারাই এই উন্নয়ন বয়ানকে একটা স্থায়ী রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময়ে কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার করার চেষ্টার কথা বলা হয়েছিল। যেমন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংস্কার, ব্যাংক খাতের সংস্কার ইত্যাদি। এখন মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে কেন এসব সংস্কার শেষ পর্যন্ত হয়নি। কারণ, যে আঁতাতের কথা বলা হয়েছে, তারা সংস্কারবিরোধী একটি জোট তৈরি করে নিয়েছিল। তারা প্রতি পদে পদে সংস্কারকে বাধা দিয়েছে। কারণ, এই সংস্কার ছিল তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে।
সবশেষে উপসংহার টেনে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশের ভেতরে সাম্প্রতিককালে একটি অনাচার অর্থনীতির সৃষ্ট হয়েছিল। এই অনাচার অর্থনীতির পেছনে একটি কলুষ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সেই কলুষ সম্পর্কের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে উর্দি পরা ও উর্দি ছাড়া আমলারা যেমন ছিলেন, এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন রাজনীতিবিদেরা এবং একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। এঁরা সবাই মিলে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কুক্ষিগত করে ফেলেছিলেন। সে সময় উন্নয়নের একটি বয়ানও সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেই অনাচার অর্থনীতির ঘাটতিকে পূরণ করার জন্য। আর সেই উন্নয়নের বয়ানকে রক্ষা করার জন্য স্বৈরাচারী রাজনীতির প্রয়োজন পড়েছিল।
তিনি বলেন, শেষ বিচারের রাজনীতি ঠিক না হলে স্বচ্ছতা, দক্ষতা, জবাবদিহিতা, সুষম উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, তার ওপরই আগামী দিনের রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার নির্ভর করবে। এই সংস্কারগুলোর পরিধি, ধারাবাহিকতা ও গতি কী হবে তা নির্ভর করবে চলমান অর্থনীতিতে সরকার কতখানি আশ্বস্ত থাকবে, জনগণ কতখানি স্বস্তি পাবে, তার ওপর।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এই মুহূর্তে বিভিন্ন ধরনের চলমান পদক্ষেপ চলছে। সরকারের দিক থেকে বিভিন্ন ধরনের ইতিবাচক সংস্কার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা ও উদ্যোগ লক্ষ করছি। একই সঙ্গে আমরা লক্ষ করছি বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক বিধিনিষেধ। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের ওপরে যখন আমরা কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করি, তখন তার অর্থনৈতিক তাৎপর্য আছে। এর মানে হলো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের রাজনৈতিক ভূমিকার পাশাপাশি আমরা তাদের অর্থনৈতিক ভূমিকাকেও সংকুচিত করার আশঙ্কা সৃষ্টি করেছি। এটা যে হবেই তা বলছি না। তবে এ বিষয়গুলোকে আগামী দিনে মনে রাখতে হবে সংস্কার পদক্ষেপগুলো টেকসই করার জন্য।’