২০১৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি। এরপর আরও ১০টি পণ্য এ মর্যাদা পেয়েছে।
জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (জিআই) বা ভৌগোলিক নির্দেশক চিহ্ন হিসেবে অনুমোদন পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশের আরও দুটি পণ্য। এগুলো হচ্ছে শীতলপাটি ও বগুড়ার দই। এ দুটি পণ্যের জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয়ে কাজ করছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)।
ডিপিডিটির উপনিবন্ধক আলেয়া খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, বগুড়ার দই ও শীতলপাটির জন্য যে আবেদন করা হয়েছিল, তা যাচাই–বাছাই চলছে। প্রক্রিয়াটি শেষ পর্যায়ে আছে। কয়েক দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। এরপর গেজেট প্রকাশ করা হবে।
সাধারণত একটি নির্দিষ্ট উৎপত্তিস্থলের কারণে কোনো পণ্যের গুণগত মান নিয়ে খ্যাতি তৈরি হলে তাকে জিআই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পণ্যের উৎপত্তিস্থল তথা শহর, অঞ্চল বা দেশের নামে এ নিবন্ধন দেওয়া হয়। তবে এ জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনকে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর বরাবর আবেদন করতে হয়।
বগুড়ার দই ও শীতলপাটির জন্য যে আবেদন করা হয়েছিল, তা যাচাই-বাছাই চলছে। প্রক্রিয়াটি শেষ পর্যায়ে আছে। কয়েক দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। এরপর গেজেট প্রকাশ করা হবে।আলেয়া খাতুন, উপনিবন্ধক, ডিপিডিটি
নিয়মানুযায়ী, আবেদন আসার পরে তা যাচাই–বাছাই করে ডিপিডিটি। একাধিক প্রতিষ্ঠান একই ধরনের পণ্যের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করলে যৌথ শুনানির মাধ্যমে তা সমাধান করা হয়। এরপর ওই পণ্যের নিবন্ধন অনুমোদন দিয়ে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়।
গেজেট প্রকাশের দুই মাসের মধ্যে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা দেশ তাতে আপত্তি না জানালে চূড়ান্ত স্বীকৃতির সনদ দেয় ডিপিডিটি। তখন ওই পণ্যের একক স্বত্ব হয়ে যায় শুধু বাংলাদেশের। সে অনুযায়ী চূড়ান্তভাবে জিআই সনদ পেলে সারা বিশ্বে বগুড়ার দই ও শীতলপাটির একক ব্র্যান্ডিং তৈরি হবে। এতে দেশের পাশাপাশি বিশ্ববাজারেও পণ্য দুটির প্রতি ক্রেতারা আস্থা পাবেন এবং এগুলোর রপ্তানির সম্ভাবনা তৈরি হবে।
এখন পর্যন্ত দেশের ১১টি পণ্য ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পায় ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি। এরপর ইলিশ মাছ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরশাপাতি আম, বিজয়পুরের সাদামাটি, কালিজিরা, দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল, রাজশাহীর সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, ঢাকাই মসলিন, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম ও বাগদা চিংড়ি জিআই স্বীকৃতি পায়।
ট্যারিফ লাইনে দইয়ের নাম না থাকায় রপ্তানি করতে সমস্যা হচ্ছে। পণ্যটি জিআই স্বীকৃতি পেলে আনুষ্ঠানিকভাবে রপ্তানির সুযোগ তৈরি হবে।মো. রেজাউল করিম, সভাপতি, রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি, বগুড়া শাখা
মসলিনের মতো বহু আগে থেকেই দেশে–বিদেশে বাংলাদেশের শীতলপাটির কদর। সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার তেঘরিয়া গ্রামের শীতলপাটি জায়গা করে নিয়েছিল মোগল রাজদরবার ও ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়ার রাজসভায়। পণ্যটির গুরুত্ব বিবেচনা করে ২০১৭ সালে শীতলপাটির বুননশিল্পকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো।
শীতলপাটির ঐতিহ্য অনেক পুরোনো হলেও পণ্যবৈচিত্র্যের অভাব ও কারিগরি সমস্যার কারণে এটির বাজার ছোট হয়ে পড়েছে। সে জন্য শীতলপাটিকে বাংলাদেশের বিশেষায়িত পণ্য হিসেবে বিশ্ববাজারে তুলে ধরতে ২০২১ সালে ডিপিডিটির কাছে জিআই সনদের জন্য আবেদন করে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। বর্তমানে সিলেট, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শীতলপাটি তৈরি করা হয়।
এদিকে পণ্যটির নিবন্ধন পেতে একই সময়ে বাংলাদেশ বাঁশ, বেত ও পাটি শিল্প ফাউন্ডেশন নামে চট্টগ্রামভিত্তিক একটি সংগঠনও আবেদন করে। দুটি প্রতিষ্ঠান আবেদন করায় ডিপিডিটি উভয় পক্ষের কাছে কয়েক দফায় তথ্য–উপাত্ত চায়। পাশাপাশি যৌথ শুনানির আয়োজন করে। ডিপিডিটি জানায়, বাংলাদেশ বাঁশ, বেত ও পাটি শিল্প ফাউন্ডেশন তাদের দাবির পক্ষে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। তাই বিসিকের আবেদন বিবেচনায় নিয়ে ‘বাংলাদেশের শীতলপাটি’কে জিআই পণ্য নামে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে।
শীতলপাটির বিশেষত্ব হলো, এটি সম্পূর্ণ হাতে তৈরি এবং ব্যবহারে একধরনের আরামদায়ক শীতল অনুভূতি পাওয়া যায়। স্থানীয়ভাবে মুর্তা বা পাইত্র্যা বা পাটি বেতি (বৈজ্ঞানিক নাম শুমানিয়ানথাস ডাইকোটোমাস) নামে পরিচিত গুল্মজাতীয় গাছের বাকল দিয়ে এই পাটি বানানো হয়। এতে বিভিন্ন ধরনের নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়।
শীতলপাটি সাধারণত মেঝেতে পাতা আসন কিংবা খাটের ওপর মাদুর হিসেবে বিছানো হয়। এ রকম একেকটি পাটি তৈরিতে ১৫ থেকে ২০ দিন সময় লাগে। দাম শুরু হয় ৫০০ টাকা থেকে, যা নকশাভেদে ৬ হাজার টাকার বেশি হয়। এ ছাড়া শীতলপাটি দিয়ে ফুলদানি, শোপিস, খেলনা, জায়নামাজ, ফাইল ফোল্ডার, কলমদানি, বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ, ছবি ও আয়নার ফ্রেম, ওয়ালমেট, জুতাসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য বানানো হয়।
বগুড়ার দইকে জিআই পণ্য করার জন্য আনুষ্ঠানিক আবেদন করে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির বগুড়া জেলা শাখা। সংগঠনটি ২০১৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরে (ডিপিডিটি) এ আবেদন করে। তা কয়েক দফায় যাচাই–বাছাই শেষে এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের পর্যায়ে রয়েছে। ডিপিডিটির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বগুড়ার দই নিয়ে আরও কিছু তথ্য যাচাই করে চলতি সপ্তাহেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।
রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির আবেদনে বলা হয়, প্রায় দেড় শ বছর আগে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার নীলকণ্ঠ ঘোষের হাত ধরে বগুড়ার দইয়ের যাত্রা শুরু হয়। বগুড়ার দই ব্রিটেনের দুই মহারানি ভিক্টোরিয়া আর রানি এলিজাবেথও খেয়েছেন। বর্তমানে বগুড়ার দুই শতাধিক দোকানে দই বানানো হয়।
এসব কারখানায় সরাসরি কাজ করেন প্রায় সাত হাজার মানুষ। এ ছাড়া দুধ উৎপাদন, দইয়ের পাত্র (মাটির), মোড়ক ও বাঁশের কাঠামো তৈরির মতো খাতে আরও ১০ হাজার মানুষ জড়িত। বগুড়ার দই ১৫০–২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি মো. রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনানুষ্ঠানিকভাবে বগুড়ার দই পৌঁছে গেছে। ফলে এ পণ্যের রপ্তানির সম্ভাবনা আছে। তবে ট্যারিফ লাইনে দইয়ের নাম না থাকায় রপ্তানি করতে সমস্যা হচ্ছে। পণ্যটি জিআই স্বীকৃতি পেলে আনুষ্ঠানিকভাবে রপ্তানির সুযোগ তৈরি হবে।